ABABHASH A Kolkata-based Publisher in the Business of Ideas

Recently added item(s) ×

You have no items in your shopping cart.

‘অর্থবাদ ও বৈদিক দেবতা’ হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়

“ছোটোবেলার কথা স্পষ্ট মনে আছে, আপনাদেরও অনেকেরই মনে পড়বে- পূজা- পার্বণের সময় মা নারকেলের নাড়ু পাকাচ্ছেন, নিষ্পাপ লুব্ধ কৌতূহলে একটি বালক তাকিয়ে দেখছে, জিভের জল সামলে নিচ্ছে। ‘মা, আমায় একটা দাও না।‘ –‘ছিঃ, ওকথা বলতে নেই, আগে দেবতা খাবেন, পরে তোমরা প্রসাদ পাবে।‘ শুধু নিষ্ফল মিনতি আর চেয়ে থাকাই সার। এবার কিন্তু অশিক্ষিত-পটু নির্বোধ বালকটি বিরক্ত হয়ে এমন একটি প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করল যার জন্য মা মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না- ‘দেবতা কখন খায়, কী করে খায়? ভোগের পরও নৈবেদ্যের থালা যেরকম ছিল সেরকমই থেকে যায়, নৈবেদ্যের তো এতটুকুও কমতি হয় না। দেবতা যদি খাবেই তবে নৈবেদ্যের নাড়ু কমে যায় না কেন?’ সহজ সরল প্রশ্ন, এজন্য ন্যায়শাস্ত্র পড়ার দরকার হয় না। মনে করে দেখুন এরকম প্রশ্ন আপনারাও ছোটোবেলা করেছেন। এসব ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে, মার প্রতিষেধক অস্ত্র হল একটু স্নিগ্ধ হাসি, আর বিজ্ঞোচিত উক্তি- ‘এসব কথা বড়ো হলে বুঝবে।‘

    বড়ো হয়ে বালক কিছুটা বুঝেছে ঠিকই, তবে মা যা ভেবেছিলেন তার উলটো। সরল বালক তখন জানত না, তার এই সহজ যুক্তির পিছনে নিষ্কম্প সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দুই সুপ্রাচীন মহর্ষি, পূর্ব মীমাংসা দর্শনের মূল প্রবক্তা জৈমিনি এবং ভাষ্যকার শবর স্বামী। বৈদিক ধর্ম ও দর্শনের ঐতিহাসিক অনুশীলনে এই দুটি নাম শুধু অতিশ্রদ্ধেয় নয়, নিত্যান্ত অপরিহায্য। একদিকে এরা বৈদিক যাগযজ্ঞের একনিষ্ঠ সমর্থক ও বাখ্যাকার। অন্যদিকে এরাই আবার দেবতা, ঈশ্বর, পরলোক, মুক্তি প্রভৃতি বিষয়ে এমন সব কথা বলেছেন যা বর্তমান যুগের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি-সঞ্জাত যুক্তিবাদী মননধর্মের নিকটও বিস্ময়কর। কথাগুলি বলেছেন কিন্তু যাগযজ্ঞের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে। আপনারা অনেকেই আমার মতো ছেলেবেলায় মার কাছে যে প্রশ্ন তুলে ধরেছেন সেই একই প্রশ্ন এই দুই মহর্ষি কীভাবে উত্থাপন করেছেন এবং কীভাবে সমাধান করেছেন তা একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক।

দেবতায় বিশ্বাসী পূর্বপক্ষের বক্তব্য

প্রশ্নটি তোলা হয়েছে মীমাংসা-দর্শনের দেবতা-অধিকরণে (৯।১।৬-১০)। যজমান কোন ফল কামনা ক’রে যজ্ঞ করেন? যজমানের এই ফললাভে প্রধান ভূমিকা কার? যজ্ঞের না দেবতার? যজ্ঞকর্ম কি আপন শক্তিতে স্বাভাবিকভাবেই ফল উৎপাদন করে, অথবা যজ্ঞে নিবেদিত হবি বা নৈবেদ্য-ভোজনে পরিতৃপ্ত দেবতা প্রসন্নচিত্তে যজমানকে অভীষ্ট ফল প্রদান করে? পূর্বপক্ষ বা প্রতিবাদী বিরোধী পক্ষের বক্তব্য হল- দেবতাই ফল দান করে, দেবতার অনুগ্রহ লাভই যাগযজ্ঞের সবচেয়ে বড়ো কথা। কারণ, যাগ মানেই তো দেবপুজা। যজ্ঞে প্রযুক্ত মন্ত্রে দেবতাকে সম্বোধন করে আহ্বান করা হয়- তুমি আমাদের নিবেদিত হবি গ্রহণ কর, পানভোজনে আপ্যায়িত হয়ে আমাদের প্রার্থিত ফল দান কর। আবার যাগ মানে হল দেবতার ভোজন। ভোজ্যদ্রব্য দেবতাকে দান করার কথা তো বেদেই রয়েছে। দেবতা খাবেন বলেই তো ভোজ্যদ্রব্য দেবতাকে নিবেদন করতে হয়। পূজা আর পূজনীয়ের মধ্যে পূজনীয়ই প্রধান, পূজা গুণীভূত বা অপ্রধান। যেমন অতিথির পরিচর্যায় অতিথিই প্রধান, অতিথি এলেন বলেই তো পরিচর্যার প্রশ্ন ওঠে। পরিচর্যা যেমন অতিথির জন্য যাগযজ্ঞও তেমনি দেবতার জন্য। তাই যজ্ঞকর্মে দেবতাই প্রধান, যাগটা গৌণ। দেবতা অর্থপতি, সকল বস্তুর ঈশান বা অধীশ্বর। একথা বেদেই রয়েছে- ‘ইন্দ্র আকাশ, পৃথিবী, জল ও মেঘের ঈশ্বর। তিনি বৃদ্ধের ঈশ্বর, প্রাজ্ঞের ঈশ্বর। লব্ধ ধনসম্পদ রক্ষার জন্য ইন্দ্রকেই ডাকতে হবে, অলব্ধ ধনসম্পদ লাভের জন্যও তাকেই ডাকতে হবে’ (ঋক সং ১০।১৬।১০)।     

    কিন্তু ভোজন করার মতো কাজ করতে হলে তো দেবতার শরীর থাকা প্রয়োজন। তাই দেবতা ‘বিগ্রহবর্তী’। বেদেই তার প্রমাণ। ‘পাশহস্ত বরুণ, বজ্রহস্ত ইন্দ্র।‘ ‘হে ইন্দ্র আমরা ধনকামী তোমার দক্ষিন হস্ত গ্রহণ করেছি’ (আমাকে দান না করে যেতে পারবেন্ না, এই বলে যাচক যেমন দাতার হাত ধরে- সায়ণাচারয- ঋ: ১০।৪৭।১)। ‘হে ইন্দ্র, তুমি অসীম আকাশ ও পৃথিবীকে গ্রহণ করেছ, কী বিরাট তোমার মুষ্টি’ (ঋ: ৩।৩।৫)। সোমপানে হৃষ্ট ‘ইন্দ্রের বিপুল গ্রিবা, বিরাট জঠর সুন্দর বাহু; ইন্দ্র শত্রুদের নিধন করেছে’(ঋ: ৮/১৭/৮)। দেবতা যদি নিবেদিত হবি নাই ভোজন করবে তবে তার কাছে বিবিধ ভোজ্যদ্রব্য উপস্থিত করা হবে কেন? বেদে যখন সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে তখন তো আর এর কোনও ঔপচারিক বা গৌণ আলংকারিক অর্থ গ্রহণ করা যায় না। যদি বলেন, দেবতাকে ভোজনের জন্য আহ্বান করা হয়েছে কোথায়,- বেদেই তার প্রমাণ রয়েছে।– ‘হে ইন্দ্র, উত্তরবেদিতে স্থাপিত এই হবি তুমি ভক্ষণ কর, এই অন্ন ও সবনীয় পুরোডাশ প্রভৃতি উদরে ধারণ কর, এই সোম পান কর। তোমার অনুগ্রহে অন্নপুষ্ট আমরা আবার যেন তোমার কাছে ধনসম্পদ কামনা করতে পারি। আমাদের ধনকামনা যেন সত্য হয়’ (ঋ: ১৩।১১৬।৮)। কেবল ইন্দ্র নয়, অগ্নিদেবতাও অন্ন ধারণ করে- ‘আকাশে বিচরণশীল জলরাশিকে অগ্নি জলস্রোতে পরিণত করে, তারপর ঐ নির্মল জলরাশি দ্বারা ভুমি পরিব্যাপ্ত করে। (বৃষ্টিবিধৌত উর্বর পৃথিবীর) অন্নরাশি অগ্নি আপন জঠরে ধারণ করে, অন্নপ্রসূতি নূতন ঔষধিসমূহের অভ্যন্তরে অবস্থান করে’ (ঋ: ১।৯৬।১০)।

    দেবতার প্রসাদভিক্ষু পূর্বপক্ষ স্বপক্ষে এত বৈদিক নজির টেনেও একটি প্রশ্নে খুবই অস্বস্তি বোধ করেছেন। প্রশ্নটি কিন্তু বালকের সেই সহজ সরল প্রশ্ন- দেবতা যদি সত্যিই খেতেন নৈবেদ্য তো কমে যেত? (ন দেবতা ভুঙ্্ক্তে। যদি চ ভুঞ্জীত, দেবতায়ে প্রত্তং হবিঃ ক্ষীয়েত।– দেবতা ভোজন করেন না। যদি বা করতেন, দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত হবি ক্ষয়প্রাপ্ত হত)। একটা কল্পনাকে সত্য বলে মেনে নিলে তাকে রক্ষা করার জন্য আর একটা কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। পূর্বপক্ষ যে উত্তর দিলেন, তাতেও কল্পনার জালে অনবস্থাপাতের আভাস দেখা যাচ্ছে (fallacy of infinite regress)।  

    পূর্বপক্ষ উত্তর দিলেন- দেবতা মানুষের মতো খান না। দেবতা অন্ন ভোজন করেন না। কিন্তু মধুকরীর মতো অন্নের রসটুকু শুধু চুষে নিয়ে ছিবড়ের মতো নীরস অন্নরাশি ফেলে রেখে যান। তাই তো দেবভোগের পর প’ড়ে থাকা অন্ন নীরস মনে হয়। সুতরাং দেবতা অন্নরস গ্রহণ করেন না। (অন্নরসভোজিনী দেবতা মধুকরীবদ অবগম্যতে। কথম্? দেবতায়ৈ প্রত্তং হবিঃ নীরসং ভবতি। তস্মাদ্ অন্নরসং ভুঙ্্ক্তে দেবতা ইতি গম্যতে)।

    যদি জিজ্ঞাসা করেন- পানভোজনে আপ্যায়িত দেবতা যজমানের অভীষ্ট সাধন করে- ঠিক এই কথাটি কোথায় আছে? ওটা তো কিছু কিছু বেদবচন থেকে আপনারা অনুমান করেছেন। না, একথা স্পষ্ট ক’রে বেদেই বলা হয়েছে-

    ‘যে যজমান দেবতাদের পিতৃস্বরূপ ব্রহ্মণস্পতিকে (বৃহস্পতি) সশ্রদ্ধচিত্তে হবিপ্রদানের দ্বারা পরিপূর্ণভাবে পরিচর্যা করে সেই যজমান সেবাপরায়ণ ভৃত্য, করদাতা প্রজা, ব্রাহ্মণাদি জাতি ও পুত্রপৌত্রাদির সহিত সম্মিলিতভাবে ভোজ্যদ্রব্য উপভোগ করে, বন্ধুবান্ধবের সহিত সন্মিলিতভাবে ধনসম্পদ উপভোগ করে’ (তৈত্তিরীয় সংহিতা- ২।৩।১৪)। পূর্বমীমাংসার বিরোধীপক্ষ এমন বক্তব্যের উপসংহার করলেন- সুতরাং বৈদিক প্রমাণের দ্বারাই প্রমাণিত হচ্ছে, হবিপ্রদানের দ্বারা দেবতার আরাধনা করলে দেবতা প্রীত হয়ে ফল দান করেন। তাই যজ্ঞকর্মে দেবতারই মুখ্য ভূমিকা।

    বিস্তৃত ও অবিকৃতভাবে পূর্বপক্ষের বক্তব্য উপস্থিত করার মধ্য দিয়ে মীমাংসক জৈমিনি ও শবরস্বামী পূর্বপক্ষের গূঢ় অভিপ্রায়টি ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছেন বলে মনে হয়। অভিপ্রায়টি বোধ হয় এই- আপনারা মীমাংসক, আপনারা যাজ্ঞিক। বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের আপনারা শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাতা। বেদ আপনাদের সর্বশ্রেষ্ঠ নির্ভরযোগ্য শাস্ত্র যার বিধান আপনারা অলঙ্ঘনীয় অবাধিত অব্যর্থ ব’লে মনে করেন। সেই বেদের সর্বস্তরে ছড়িয়ে আছে দেবতার স্তুতিগান, অন্নপান নিবেদনের দ্বারা দেবতার তুষ্টিবিধান। আর বিনিময়ে কামনাপূরণের জন্য দেবতার প্রসাদভিক্ষা। অথচ যাগযজ্ঞে অবিচল বিশ্বাস থাকা সত্তেও দেবতা বা ইশ্বরের অস্তিত্ব সন্বন্ধে আপনারা অবিচল অবিশ্বাস পোষণ করেন। এই স্ববিরোধ (self-contradiction) কাটিয়ে ওঠা কি আপনাদের পক্ষে দুঃসাধ্য নয়?”…

হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, ‘বৈদিক ধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন’, অবভাস।

অনলাইনে বই সংগ্রহ করতে ক্লিক https://www.ababhashbooks.com/vaidik-dharma-o-mimansha-darshan.html

Leave a Reply

Sorry, you must be logged in to post a comment.