ABABHASH A Kolkata-based Publisher in the Business of Ideas

Recently added item(s) ×

You have no items in your shopping cart.

‘কেন লিখি’ মণীন্দ্র গুপ্ত

কেন লিখি। এই প্রশ্নের উত্তর অনেকবার দিয়েছি, এক এক বার উত্তর এক এক রকম হয়েছে। মেজাজ যেমন যেমন ছিল উত্তরও তেমন তেমন হয়েছে। তাহলে আমার চিন্তায় বোধ হয় তেমন অটলতা নেই। কেন লিখি? আবারও মনের মধ্যে নুতন করে কারণ খুঁজতে থাকি। এবং আধ ঘণ্টা খুঁজেও কোনো কারণের সন্ধান পাই না।

  সাহিত্যসম্রাট বলেছেন- লিখিতেই যদি হয় পরোপকারের জন্য লিখিবে। কথাটা আমার এক্কেবারে পচ্ছন্দ নয়। লেখক বিশ্ববন্ধু নন, তাঁর লক্ষ্য তিনি নিজে। তিনি লেখেন আর নিজের মধ্যে নিজেকে উপভোগ করেন।

  বুদ্ধদেব বসু একজন বিদেশি কবির অনুবাদ করেছিলেন খানিকটা এইরকম, কবিমশাই, কবুল করুন আপনি কেন লেখেন। সমাজে প্রতিষ্ঠা পাবার জন্যে? কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে? কোনো মেয়ের মন পাবার জন্যে?- বলুন, বলুন কবুল করুন।

  হ্যাঁ, এটা একটা অকাট্য অভিযোগ বটে। শুরুর দিকে অনেকেরই এমনটা ঘটে। আমারও ঘটেছিল। কিন্তু সে মতিভ্রম মাত্র কয়েক মাসের। তারপর দীর্ঘ এক জীবন কেটে গেল। কত সুখ দুঃখ বসন্ত হেমন্ত গেল। আপনারা যাঁরা এর মধ্যে আছেন, সবাই জানেন, একবার এই স্বতশ্চল স্রোতে গা ভাসালে, মোহনায় গিয়ে সমুদ্রে না মেশা পর্যন্ত রেহাই নেই। একটা লোককে লেখক করে রাখবার জন্যে অনেক শক্তি কাজ করে। জীবন তাকে বঞ্চনা করে। দিয়ে কেড়ে নেয়, বঞ্চনার চেয়েও যা অধিক। তারপর এক সময়ে দেখা যায় কুলে কুলে সব ভরে আছে, পাড় জুড়ে সাদা কাশফুলের বন হাওয়ায় দুলছে। তারপর আবার ফাঁকা। প্রকৃতির মধ্যে শান্ত হয়ে আছে দীন দরিদ্র জীবন।মানুষের সঙ্গই মানুষের একমাত্র কাম্য নয়, প্রকৃতি এবং বনবাসী প্রাণীদের দেখে বুঝতে পারি, অর্থনীতির বাইরে তৃষিত প্রাণ কীভাবে তৃপ্ত হয়।

  চলে যাবার আগে, এইসব লিখে লিখে যদি জানিয়ে যেতে পারি। লিখতে লিখতে, খোয়াতে খোয়াতে এত দূর এলাম বোধ হয় এই জন্যেই।

লেখার একটা অন্য দিক আছে। অন্যের কেমন জানি না। আমার লেখার সঙ্গে আমার জীবনযাপনের মিল বোধ হয় কম। আমার লেখার বীজটুকুই আসে জীবন থেকে, কিন্তু তার চাষ হয় মনের মধ্যে, ফসল যেটুকু ওঠে সবই মনের মাঠের। কিন্তু মন কেউ দেখতে পায় না, চোখে পড়ে বাইরের দীনহীন চেহারাটাই।

  লেখা পড়ে পছন্দ হয়েছিল, তাই কেউ কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কিন্তু দেখার পরে, আমি টের পাই, তাঁদের স্বপ্নভঙ্গ হয়। একবার বহুদূর দেশ থেকে এক যুবক এল, সঙ্গে তার সদ্যপরিণীতা স্ত্রী। কেন জানি না তার ধারণা হয়েছিল, আমি বোধ হয় মুনিঋষি গোছের কেউ। আমাকে দেখে, অসজ্জিত আমার কথাবার্তা শুনে, প্রথম দর্শনেই তার মোহ ভাঙল।

  কদিন আগে এক যুবক পর পর দুদিন এল। দ্বিতীয় দিনে যাবার আগে সরল এবং হতাশাভরা গলায় বলে গেল- বই পড়ে, যে পুরুষটিকে দেখব বলে আশা করে এসেছিলাম তাকে দেখলাম না।

  এসব তিরস্কারের সামনে দাঁড়িয়ে আমি কেমন কাঁচুমাচু হয়ে যাই। কী করি বলুন তো, দুএকটা বই লিখে আমি কি এমন অপরাধ করেছি যে আমাকে মুনিঋষি সেজে থাকতে হবে! সাড়ে পাঁচ ফুট শরীরটাকে সাড়ে সাত ফুট বানাতে হবে। অথবা দোষটা হয়তো আমারই- লিখে লিখে আমি বোধ হয় একটা ভুল প্রত্যাশা তৈরি করেছি।

  আমি আশি পেরিয়ে নব্বইয়ের কাছাকাছি চলে এসেছি। গায়ের চামড়া এখন মাছের আঁশের মতো কোঁচকানো, হাড় পাটকাঠির মতো ভঙ্গুর। এখনও কি আমাকে অন্যের পছন্দমতো হয়ে সেজেগুজে বসে থাকতে হবে।

  ছেলেবেলায় আমাদের দুধ দিয়ে যেত মনিরুদ্দি মিয়া। নীল লুঙ্গি, খালি গা, ফোকলা মুখ, ছাগল দাড়ি। চার মেইল দূর থেকে আসত, একটু নিশ্বাসের কষ্ট হত। সেই মনিরুদ্দির সঙ্গে এখন আমার চেহারার মিল।

  আমি এখন  হিন্দু মুসলমানের অতীত। শিশু বৃদ্ধের অতীত। মূর্তি ও ভাবমূর্তির অতীত। নিন্দা স্ত্ততি, সমস্ত মন্তব্যের অতীত জায়গায়, এখন আমাকে ছায়ায় বসে একটু ঝিমতে দিন।‘   

মণীন্দ্র গুপ্ত, গদ্যসংগ্রহ-২, অবভাস

অনলাইনে কিনতে ক্লিক করুন https://www.ababhashbooks.com/gadyasangraha-2.html

Leave a Reply

Sorry, you must be logged in to post a comment.