খুব প্রত্যক্ষ ও একনিষ্ঠভাবে, অর্থাৎ অন্য কোনো প্রসঙ্গ বা চিন্তার অবতারণা না করে মণীন্দ্র গুপ্ত বালকবেলার স্মৃতি অবলম্বনে যে কয়েকটি কবিতা লিখেছেন, সেগুলি হল নীল পাথরের আকাশ-এর ‘একখণ্ড জমি, একটি দুপুর ও আমার শৈশব’, বাড়ির কপালে চাঁদ-এর ‘লাল লাল মাদারের ফুল’, ‘ঝাউগাছে বাদুড়দের বাড়ি’ এবং সম্ভবত ‘দুঃখ বালক’। অক্ষয় মালবেরি-র পাঠকের কাছে এই জগৎ সুপরিচিত; তবু কবিতা বলেই স্মৃতি বিশিষ্ট আর-এক আদলও পায়, যখন একলা ছেলে ‘একখণ্ড জমি, একটি দুপুর ও আমার শৈশব’-এ দুপুর রৌদ্র সেজে বরিশালের নিঝুম গ্রামের বাঁশতলা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখে, ভরন্ত দিন পাকা বেত ফল হয়ে নুয়ে পড়েছে। তারাবন, ভাঙা হাঁড়ি, নেউল, ক্রুদ্ধ গোসাপ, সরপুঁটি, বাঁশের বাকল সংবলিত ছেলেবেলার দুপুর থেকে সন্ধ্যা মণীন্দ্র গুপ্ত যেভাবে বর্ণনা করেন এই কবিতায়, তা থেকে অনুমান করা যায়, এই স্মৃতির জগৎ তাঁর জন্য পরিণত বয়সে ‘লুপ্ত এক রোমাঞ্চিত খেলাঘর’ হয়ে সঞ্জীবনীর মতো আছে (‘একখণ্ড জমি, একটি দুপুর ও আমার শৈশব’, কবিতাসংগ্রহ, পৃ. ২৫)। যাপিত অভিজ্ঞতার এই স্মৃতি তাঁর জন্য বহুদিন পরেও অনিঃশেষ পুষ্টি: ‘পাঁচশো বছর আগেকার নদীর বাঁকের গ্রামখানি যেন একটি ঘন ক্ষীর ভরা জামবাটি— তার কানায় লেগে আছি আমরা পিঁপড়ের মতন’ (গদ্যসংগ্রহ ২, পৃ. ২৪২)। তাই বলে কি স্মৃতিধৃত জগতের সঙ্গে বাস্তবিক বিচ্ছিন্নতার কষ্ট নাগরিক কবির জীবনে সম্পূর্ণ দূরীভূত হয় ? হয় না: ‘কতকাল হল শেয়ালদের দেখি না, গভীর রাত্রে ফেউয়ের ডাক শুনি না। আমার চোখের আড়ালে ফোঁটা ফোঁটা খেজুররস কলসিতে পড়ে’ (গদ্যসংগ্রহ ২, পৃ. ২৪৬)।
‘মানুষী স্মৃতিই মানুষ’ (অক্ষয় মালবেরি, প্রথম পর্ব, পৃ. ১১)— এই ছিল যে লেখকের কেন্দ্রীয় প্রত্যয়, তাঁর আত্মকথার পাঠক মাত্রেই স্বীকার করেন, এই লেখক স্মৃতিধর ছিলেন— বহুকাল আগের দেখাশোনার ভুবনকে তিনি বিস্ময়কর অনুপুঙ্খে ও তীব্রতায় পুনরুদ্ধার ও পুনর্নির্মাণ করতে পারতেন। বিশেষত, ঘোর শৈশবে, প্রায় ভূমিষ্ঠ হবার পর ‘প্রথম স্মৃতি’-র যে পরিসর তিনি অক্ষয় মালবেরি-র শুরুতেই উন্মুক্ত করেন, তা এক দূরগামী মানস ভ্রমণের খবর দিয়ে আশ্চর্য করে: জন্মের পর দিনের বেলায় কাঁথা-বালিশের প্যাকিং বাক্সের ভেতর শুয়ে তিনি বড়োদের শাড়িঘেরা ‘বিশাল পা’-গুলিকে হাঁটু অব্দি দেখতে পান, তখনও উঠতে শেখেননি, পায়ের জোড়াগুলি তাঁর বিছানার পাশ দিয়ে আসছে আর যাচ্ছে (অক্ষয় মালবেরি, প্রথম পর্ব, পৃ. ১১)। অক্ষয় মালবেরি লেখার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে মণীন্দ্র গুপ্ত বলেছেন, প্রথমে কিছু মনে পড়ে না, কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে ধরে চিন্তা করতে শুরু করলে প্রায় বিনা প্রয়াসেই ঘটনা, চরিত্র, আকৃতি, ইন্দ্রিয়ানুভব— সব মনে পড়তে থাকে: ‘...আপনি ভাবতে পারবেন না, কত সুদূরে পিছিয়ে যেতে পারেন’ (গদ্যসংগ্রহ ২, পৃ. ১৫২)। অবশ্য তিনি স্মৃতিকে ‘একেশ্বরী’-ও বলেন, কেননা ঝুমঝুমির শব্দ হয়ে বৃষ্টি একদিন যার কানে বাজত এবং যে অনুভব করত, কোনো টিনের ঘরে নয় বরং টিনের একটা ঝুমঝুমির ভেতরেই শুয়ে আছে, সে যেহেতু অনেক কাল আগের একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা, তাই সেই শব্দ এখন এতদিন পরে শুনতে চাইলে সেই বাচ্চাটিকেও স্মৃতিপটে ফিরিয়ে আনতে হয়, নচেৎ নবতিপর মণীন্দ্র গুপ্তকে রুদ্ধ স্মৃতির কক্ষে নিষ্ফল করাঘাতই করতে হয় কেবল: ‘দেখুন, আমার স্মৃতির ছবি আমাকেই কী রকম অস্বীকার করছে, আমাকেই ঢুকতে দিচ্ছে না’ (গদ্যসংগ্রহ ২, পৃ. ৩০৩)। নিজস্ব সংবেদন ব্যতিরেকে অন্যান্য সূত্র থেকে উপাদান এসে জোটার ফলেও অবিকল পুনরুদ্ধারের বদলে পুনর্নির্মাণের প্রসঙ্গ জরুরি হয় বলে সাক্ষাৎকারে ইঙ্গিত দিয়েছেন মণীন্দ্র গুপ্ত : ‘হ্যাঁ।মানে, আমার যত দূর স্মৃতিটা যায়। আচ্ছা, এখন আমি নিজে, আমার মনে হয়, স্মৃতিটা তো গেছেই, কিন্তু, হয়তো আমি সমস্তটা পরে কখনো কিছুটা শুনেছি। সেটা আমি স্মৃতি বলে নিয়ে নিয়েছি’ (নতুন কবিসম্মেলন, পৃ.২৫৫)। প্রত্যক্ষ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা যখন অভিজ্ঞতার স্মৃতি বা অভিজ্ঞতাজাত অনুভূতির স্মৃতিতে পরিণত হয়, সময়ান্তরের কারণে ও মনের রঙে রঞ্জিত হয়ে তারা প্রত্যক্ষতা হারিয়ে রূপান্তরিত হয়। এই অর্থে স্মৃতি প্রত্যক্ষ নয়, বরং ‘অলৌকিক’ বর্ণচোরা অভিজ্ঞতা (গদ্যসংগ্রহ ১, পৃ. ১৪)। যেহেতু ‘মানসক্রিয়াভূমি’ অর্থাৎ মন ও অভিজ্ঞতার সংশ্লেষের স্বরূপ এক-একজনের ক্ষেত্রে এক-একরকম, তার পরিণতি হিসেবে স্মৃতি হয়ে ওঠে অ-সামগ্রিক, অ-পূর্বনির্ধারিত, আপেক্ষিক ও তির্যক এক ব্যাপার (গদ্যসংগ্রহ ১, পৃ. ১৪)। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এক-এক ব্যক্তির মনের রঙে এক-একভাবে রাঙিয়ে ওঠে বলে প্রদত্ত পৃথিবীর বিপরীতে অর্থাৎ নিছক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসর্বস্ব জগতের বিপরীতে এই স্মৃতির জগৎকে মণীন্দ্র গুপ্ত বলেছেন ‘একার পৃথিবী, কোলাজ পৃথিবী’, যা বিশিষ্ট ও বিমিশ্র, যাতে খামখেয়ালিপনার ভূমিকা আছে, যা ‘জোড়াতালিতেই’ নিজের পরিচিতি পায় (গদ্যসংগ্রহ, ২, পৃ. ৩০৩)। স্মৃতি আরও এক কারণে জাদুকরি; সে আচম্বিতে বিস্মৃতির গহন থেকে এক-এক টুকরোকে উত্থিত করে। তখন যা বিস্মৃতি, তা মুহূর্তে স্মৃতি হয়। যে ছেলে জলজ্যান্ত তাকে না মনে পড়ে বিস্মৃতিপরায়ণ প্রৌঢ়ের মনে পড়ে এমন কাউকে, যে ছিলই না কোনোদিন, শুধু যে জন্মালে আদর করে যার একটা নাম রাখার কথা ছিল ! ফলে, ঘোর বিস্মৃতির কত স্তর পলির নীচ থেকে না-বাস্তবায়িত হওয়া একটা নাম সহসা উঠে এসে ‘দেখতে-পাওয়া’ এবং না-পাওয়া, ‘কাছে-থাকা’ এবং না-থাকার অন্তর্বর্তী অনিশ্চয়কে চিহ্নিত করে (‘শান্টু আর পিকলু’, কবিতাসংগ্রহ, পৃ. ২০০)।
জীবনের শেষ লগ্নে স্মৃতি ও বিস্মৃতির মধ্যে কুয়াশাবৃত সম্পর্ক রচিত হয় মস্তিষ্কে— সেই সম্পর্ক দোলাচল, সংক্রমণ ও তৃতীয় বাস্তবের সম্পর্ক— দুইয়ের কে ঠিক কে ভুল, এরা একে অন্যের ভেতর কতটা ও কীভাবে সেঁধিয়ে আছে, দুয়ের সংশ্লেষের পারস্পরিকতায় কি উঠে আসছে নতুন মিশ্রিত কোনো পরিসর— এই সম্পর্ক ও তৎপ্রসূত বিভ্রম যেভাবে অভিজ্ঞতায় পান একজন অতীতমগ্ন বুড়োমানুষ, তার পটভূমিটুকু অর্থাৎ স্মৃতি ও বিস্মৃতির মুখোমুখি হওয়াটুকু মণীন্দ্র গুপ্ত ‘নিশ্চিহ্ন-দেশের প্রান্তে’ কবিতায় লিপিবদ্ধ করেছেন। স্মৃতিকে তিনি বলেছেন ‘জলের তলার ছবি’— যা উন্মনা করে, প্রলুব্ধ করে, কিন্তু সময়ের ব্যবধান ছবির কিনারকে ঝাপসা কিংবা কম্পমান করে রাখে। সেই অনির্ণয় চেনায় অতীত ও বর্তমানের সন্ধির সূক্ষ্ম ফাঁক। যা বর্তমান, যা এখন স্পষ্টভাবে নির্ণীত বলে মনে হয়, তাও যেহেতু একদিন অতীত হয়ে গিয়ে অনির্ণয়ের কবলে পড়বে, তাই অনির্ণীত অতীতকে আজ এই বর্তমানেও অস্বীকার করা কঠিন, যে আসে স্মৃতির সরণি বেয়ে। তদুপরি, যা অতীত তা কতটা পাথুরে প্রমাণ, কতটাই বা সৃষ্টিশীল মনের উপচার— এই সন্দেহও স্মৃতির ফ্রেমগুলির কিনারা আবছা করে রাখে জলের তলায়। লক্ষণীয়, স্মৃতির সারধর্ম হিসেবে এই অনির্ণয় বা বিভ্রমকে গণ্য করতে চান বলেই যে কবিতাগুলির কেন্দ্রীয় বিষয় স্মৃতি অথবা বিস্মৃতি, সেগুলিতে বার বার সেই অনির্ণয় বা বিভ্রমের দ্যোতনা দেবার উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তী কোনো স্পেসের একটা চিত্রকল্প, কম্পনশীলতা এবং ছায়ার প্রসঙ্গ আনেন মণীন্দ্র গুপ্ত: ‘মন আর স্মৃতি এখন দিগন্তে মরীচিকার মতো কাঁপে:/ছায়ার হাত ধরে ছায়া ঐ দৌড়চ্ছে’ (‘বিকেল হল’, কবিতাসংগ্রহ, পৃ. ২৭৭), ‘দিন আর রাতে ভাগ হয়ে আছে সময়,/জীবন আর মৃত্যুতে ভাগ হয়ে আছে স্থির আকাশ’ (‘শান্টু আর পিকলু’, কবিতাসংগ্রহ, পৃ. ২০০), ‘মধ্যিখানে কেঁপে কেঁপে উঠছে ঘড়ির কাঁটা’ (‘শান্টু আর পিকলু’, কবিতাসংগ্রহ, পৃ. ২০০), ‘বিশাল পর্দার পাশে মাত্র দুইজন’ (‘জটিল ফাল্গুন’, কবিতাসংগ্রহ, পৃ. ১০৫), ‘পাড়ার সানাই বকুলতলার দিক থেকে/ছায়া সঙ্গে করে আসে তোমার উঠোনে’ (‘জটিল ফাল্গুন’, কবিতাসংগ্রহ, পৃ. ১০৫), ‘স্মৃতির গভীর ডাকে ঝনঝন করে উঠল বন... পরক্ষণেই/তার তরল ছায়ার মতো শরীর তরঙ্গিত একটা ছোট্ট লাফে/পেরিয়ে গেল/নিরক্ষীয় গ্রীষ্মের এই রাত’ (‘বৃক! বৃক!’, কবিতাসংগ্রহ, পৃ. ৭৭), ‘চারদিকে তারাবন, তলে তার ঘন ছায়া দমকে দমকে/অন্ধকার হয়ে হয়ে গিয়েছে হারিয়ে’ (‘একখণ্ড জমি, একটি দুপুর ও আমার শৈশব’, কবিতাসংগ্রহ, পৃ. ২৫)। উল্লেখজনক, স্মৃতিকে মস্তিষ্কে ধৃত গণ্য করার যে সাধারণ পরম্পরা, তার বাইরে বেরিয়ে অন্তত একবার মণীন্দ্র গুপ্ত বডি মেমরি-র ইঙ্গিত দিয়েছেন, অর্থাৎ স্মৃতি রক্ষিত হতে পারে নানা শারীরস্থানেও এবং বহির্জগৎ থেকে আগত নির্দিষ্ট স্টিমুলাসের প্রতিক্রিয়ায় সেই স্মৃতিসংবলিত শারীরস্থানসমূহ থেকে নির্দিষ্ট ইমপালস জেগে উঠে যান্ত্রিক ও পুনরাবর্তনধর্মী এক-একরকম অভিব্যক্তি ও কর্মের শৃঙ্খলা রচিত হয়। তাই একজন এলোরা গুহার ভাস্কর সাড়ে তিনশো বছরের জন্ম-জন্মান্তর পার হয়ে এসেও টের পান: ‘সেই স্মৃতি রয়ে গেছে পেশীতে’ (‘অমিতাভ, আমি কি’, কবিতাসংগ্রহ, পৃ. ২৮২)।
বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন https://www.ababhashbooks.com/manindra-gupter-jagat.html