২ মে, শনিবার
রাত ১১.৪৫ মি
‘দীর্ঘ সময় ধরে আমার শরীরে নিশ্চুপে বাসা বেঁধে থাকা ব্যাধির সঙ্গে লড়াই করে করে এখন আমার শরীর ক্লান্ত ক্লিষ্ট। এই প্রলম্বিত অসুস্থতার পর্ব আমাকে করে তুলেছে বিষণ্ণ। আজকাল শরীরের বিধ্বস্ততা মনের আকাশকেও আচ্ছন্ন করে রাখে। বেশিরভাগ সময়ই নিজের সাধ আর সাধ্যের মধ্যে চলতে থাকে দড়ি টানাটানি। মনের আবদার মানলে শরীর বেঁকে বসে, আর শরীরকে প্রশ্রয় দিলে মনের মুখ হয় তোলা হাঁড়ি। আমি শ্যাম রাধি না কূল রাখি বুঝতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়ি! তার সঙ্গে রয়েছে সামগ্রিকভাবে পৃথিবী জুড়ে চলতে থাকা করোনা-অতিমারির নির্মমতা। নিজের রোগযন্ত্রণা ছাড়াও কাছের অনেক মানুষের আকস্মিক মৃত্যু একদিকে আমার ভেতরে ঘটিয়ে চলেছে অবিরাম রক্তক্ষরণ, আরেক দিকে আমার মনকে গ্রাস করেছে মৃত্যুভয়। এক একজন প্রিয় মানুষের বিদায় বার্তা এসে পৌছয় আর আমার মনের ভেতর মাটি ধসে পড়ে আর তৈরি হয় বড়ো বড়ো গহ্বর। শূন্যতার অতলে তলিয়ে যেতে থাকি আমি। আমার জীবনের বর্তমান-অতীত, শৈশব-কৈশোর থেকে এই পড়ন্ত বেলায় শিকড় চারিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম যে মাটিতে সেই মাটিতে টান লাগে; কত অনুষঙ্গ, কত মুহূর্ত সঙ্গে নিয়ে চলে যাচ্ছেন এই আত্মজনেরা আমাকে করে দিয়ে রিক্ত, শূন্য। ধস নামার পরে পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের মতো মনে হয় আজকাল নিজেকে--- মাটি সরে গিয়ে যার শিকড়বাকড় বেরিয়ে পড়েছে, যার হারিয়ে যাচ্ছে আঁকড়ে থাকার মতো অবলম্বন। জীবনটা যেন আমার কাছে হয়ে পড়েছে মাংস-চামড়া খসে পড়া কঙ্কালের মতো; নিরাবরণ আর নিষ্করুণ। এই তো আমার ফুরোতে থাকা যাপন চিত্র!
টের পাই, নিজের অসুস্থতা এবং অতিমারির করালছায়ায় আমার জীবনের শিরা-উপশিরাগুলো শুকিয়ে আসছে। এই শেষ বেলায় নতুন করে শিকড় ছড়ানোর মতো মাটি কোথায় পাব! এই সব ভেবে ভেবে রাতগুলো হয়ে উঠেছে দীর্ঘ আর নির্ঘুম। একদিকে বিছানায় অস্থির শরীর, আরেক দিকে বিভ্রান্ত মন। যেকোনো সময় আচমকা থেমে যেতে পারে আমার এই পথ চলা; এই ভাবনা ঘুণ পোকার মতো আমার মাথায় সুড়ঙ্গ তৈরি করে চলেছে; এ কি বিদায়ের প্রস্তুতি নাকি অমূলক আশঙ্কা! আমার এই জীবন পরিক্রমার শেষে থেকে যাবে কি কিছু আফশোস, কিছু মনস্তাপ? কিছু না পাওয়ার বেদনা আমার শেষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে যাবে কি বায়ুমণ্ডলে? বলো মন, বলো? জানতে চাই নিজের কাছে।
মন বলে ওঠে, না... কোনো খেদ, কোনো অপ্রাপ্তি নয়, শেষ মুহূর্তে সঙ্গে থাকবে শুধু অপূর্ণতার বোধ, অসম্পূর্ণ কাজের পিছুটান। তবু তা অপরূপ, অপার সৌন্দর্যময়! মানব জীবন অপরিপূর্ণ, তাই সে মহময়ী, মায়াময়ী, আকর্ষক।
লিখতে বসলে এক রাশ আশঙ্কা আর উদ্বেগ মাথায় ভিড় করে আসে, লেখা এগোতে চায় না। জানি না, এই লেখা শেষ করে উঠতে পারব কি না! লিপিবদ্ধ করে যেতে পারব কি না এক অকিঞ্চিৎকর জীবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রংবেরঙের কাচের টুকরোগুলো!
এরই মধ্যে কিছুদিন হল হাতে পেয়েছি একটি প্রবন্ধের সংকলন। নিজের লেখা যখন থমকে যায়, তখন রোগভোগের এই বন্দিদশার অলস দুপুর, দীর্ঘ বিনিদ্র রাতের মন্থর ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বইটি হাতে নিয়ে বসি মাঝে মাঝে। একের পর এক পৃষ্ঠার সীমারেখা পেরিয়ে পাঠ এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করি শান্ত পুকুরের মতো ঝিম মেরে থাকা মনটা নিয়ে। চোখের সামনে বইয়ের পাতার কালো অক্ষরগুলো অনেক কিছু বলতে চায়, তার কিছু কিছু আমার মনের ভেতর পৌঁছয়, কিছু পৌঁছয় না। তবু বইটির অনুষঙ্গটুকুই এত ভালো লাগছে যে পড়া ছাড়তে পারি না। এই বইয়ের পাঠানুভব আমাকে আশ্রয় দিচ্ছে, বুকে আগলে রাখছে।
বইটা পড়তে পড়তে হটাৎ এমন একটা মুহূর্ত এল যখন মনে হল আমার নিস্তরঙ্গ মন-পুকুরে একটা ঢিল এসে পড়েছে আর সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের জলে বিলি কেটে ঢেউ উঠতে শুরু করল; পুকুরটায় এতদিন জীবনের যে ছবিটা প্রায় নিশ্চল, স্থির ভাবে ভেসে থাকত সেটায় কাঁপন লাগল, ছবিটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। আসলে বইটির একটি পৃষ্ঠায় পৌঁছে থমকে গেছে আমার পাঠ, একটি বাক্য চোখে পড়তেই।
হিরাইথ হল এক স্মৃতিমেদুর অনুভূতি, ঘরে ফেরার টান, এমন এক ঘরে ফেরার টান যে ঘরের বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। *
---বাক্যটিতে এমন কিছু লুকিয়ে আছে যা আমার মননে প্রবেশ করে অনুরণন জাগাল; আমি ভেতর থেকে কেঁপে উঠলাম, পায়ের নিচের মাটি সরে যাবার অনুভূতি হল। হিরাইথ বুকে নিয়ে জীবনের স্রোতে আমিও তো ভেসে চলেছি সেই কবে থেকে! যে ঘর বাস্তবে কোথাও নেই সেই ঘরে ফেরার টান আমাকে তাড়না করে কোথায় কোথায় না ছুটিয়ে নিয়ে গেছে! কিন্তু কোথাওই আমার স্ব-ভূমি, আমার আপন আঙিনা খুঁজে পাইনি আমি। যত বার খুঁজতে গেছি বুকভাঙা যন্ত্রণাই পেয়েছি।
‘হিরাইথ’ শীর্ষক যে প্রবন্ধ ওপরের বাক্যটি রয়েছে সেই প্রবন্ধটি পাঠ সম্পূর্ণ করতে বেশ বেগ পেতে হবে মনে হচ্ছে। বইপড়া আপাতত মুলতুবি রেখে ফিরে যেতে ছটফট করি আমার নিজের স্মৃতিমেদুরতার কাছে। দীর্ঘ অপেক্ষামাণ কোনো মীমাংসা-স্পৃহা যেন আমার ভেতরে কোথাও ঘাপটি মেরে ছিল; এখন সে আমাকে প্রবল বেগে নিজের দিকে টানতে শুরু করেছে। একে আমি এতদিন জোর করে উপেক্ষা করে এসেছি কিন্তু এবার বুঝি আর তার হাত থেকে আমার রেহাই নেই। যে ঘর, যে স্ব-ভূমির খোঁজে আমি এত বছর ধরে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়িয়েছি, যার অভাবে অন্তরের অন্তঃস্থলে এত বিপন্ন বোধ করেছি সেই ঘর বা দেশ যে বাস্তবে কোথাও নেই, এই মূলোৎপাটিত গৃহহীনতার বোধ যে আমার মনের অনুভূতিমাত্র এই উপলব্ধি মীমাংসার আকারে আমার নিজস্ব চেতনার জগতে এবার হয়ত পাকাপাকি জায়গা করে নিতে পারবে অবশেষে। ...’
*ভট্টাচার্য, পরিমল। ‘ডোডোপাখিদের গান: পরিবেশ মানুষ ‘সভ্যতা’ এবং...’, জানুয়ারি ২০১৯, অবভাস, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৯১
বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন https://www.ababhashbooks.com/sikhar-ghatha-ek-anamnir-sheshbelar-dinlipi.html