...'আমাদের দেশে সত্যিকারের গোলকধাঁধা বা ভুলভুলাইয়া জনপ্রিয় হয় মুঘল আমলে। লখনউ-এর ভুলভুলাইয়াটি বিখ্যাত, এছাড়া বিভিন্ন প্রাসাদের বাগানে ঘন লতাবিতানের সাহায্যেও তৈরি করা হতো। এগুলি সবই রাজাবাদশার প্রমোদের জন্য। কিছু প্রাচীন তান্ত্রিক পুঁথিতে গোলকধাঁধার নকশা পাওয়া যায়, যেগুলি ধ্যানের সময় মনঃসংযোগে সাহায্য করত। এছাড়া পুরাণে মহাকাব্যে গোলকধাঁধার বর্ণনা রয়েছে। চক্রব্যূহ আদতে একটি গোলকধাঁধাই। রামায়ণের কোনো কোনো পাঠে রাবণের প্রাসাদের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা গোলকধাঁধার মতো। সীতাকে সেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। কিছুকাল আগে গোয়ার কাছে একটি গুহার দেয়ালে নব্যপ্রস্তর যুগের গোলকধাঁধার রেখাচিত্র পাওয়া গিয়েছে। তবে প্রাচীন ইজিপশীয় বা গ্রিক সভ্যতায় ল্যাবরিন্থসের মতো স্থাপত্য-নিদর্শন ভারতে কোথাও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান করে পাওয়া যায়নি। সিন্ধুসভ্যতায় চাকতির আকারে পোড়ামাটির খেলনা পাওয়া যায়, তাতে গোলকধাঁধার নকশা রয়েছে।
প্রকৃত গোলকধাঁধা নাকি এমন এক বিভ্রম সৃষ্টি করে যে তার ভেতরে হারিয়ে গিয়ে কাণ্ডজ্ঞানভ্রষ্ট মানুষ ভাবতে শুরু করে, সেটি যেন কেবলমাত্র তারই জন্য, তার বোধবুদ্ধির ফাঁকফোকরগুলো হিসেব করে বিশেষভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। এইভাবে প্রতিটি মানুষ নিজের ভেতরে বয়ে নিয়ে চলে একটি গোলকধাঁধা, এবং জীবনের কোনো কোনো সঙ্গিন মুহূর্তে নিজেকে তার ভিতরে বন্দি হিসেবে দেখতে পায়। প্রত্যেক মানুষের আঙ্গুলের ছাপে রয়েছে একটি বিশিষ্ট স্বতন্ত্র গোলকধাঁধার নকশা। মানব মস্তিস্কের সেরিব্রাল কর্টেক্স-এও তাই।
সেবারের সেই যাত্রায় তেমন কোনো ব্যক্তিগত গোলকধাঁধার মুখোমুখি হয়েছিলাম কি আমরা?
দীর্ঘকাল পরে স্মৃতিচারণার সময় মানুষ নিজেকে একধরনের নৈর্ব্যক্তিকতায় দেখতে পায়। লেখাটি ফিরে পড়তে গিয়ে সেভাবেই আখ্যানের তিন যুবককে দেখি—শীত সকালের আলোয় বিধৌত মুখমণ্ডল, চারিপাশে কুয়াশার আলোছায়া। সে অনেককাল আগের কথা। এখন আমাদের মুখের ওপর থেকে সেই নবীন আলোক সরে গিয়েছে, মাথার ওপরে সূর্য ঢলছে পিছনে, ছায়াগুলো পায়ের পাতা ছেড়ে যাত্রা শুরু করেছে সামনের দিকে। কুয়াশা উবে গিয়েছে কবেই। কাছে দূরে বোল্ডার আর টিলার ছায়া ভুমির ওপর ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে সূর্যঘড়ির মতো।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে এই হল অনুসন্ধানের সুবর্ণ সময়; এসময়ে উঁচুনিচু জমির মাঝে কোনো বিলুপ্ত বসতি বা সৌধের স্তূপের আদল চোখে ধরা দেয়। একটি আত্মকথার টুকরো, একটি প্রতিবেদনের লাইন, ডায়েরির ভাঁজে শুকনো পাতার শিরাউপশিরা, কিংবা পুরোনো দিনের সিপিয়া ফোটোগ্রাফে আচম্বিতে ফুটে ওঠে স্মৃতিখণ্ড। তার মধ্যে থেকে কখনো মিলেও যায় গোলকধাঁধার দিকচিহ্ন, চাবি।
স্মৃতি, যা একই সঙ্গে ব্যক্তিগত ও পারস্পরিক : বদলাবদলি করে পরা পোশাকের মতো, একই গ্লাসে চুমুক একই সিগারেটে টানের মতো, একই নারীকে প্রেম, ঘুমের ভেতরে হাতবদল করে নেওয়া দুঃস্বপ্ন, জেগে উঠে পরে নেওয়া একে অপরের মুখের মতো স্মৃতি।
সেই স্মৃতির খননে উঠে আসে মৃৎপাত্র, জোয়াল, একটি কুয়োর অবশেষ, কালো উত্তল আয়না, বাঁশি ও কেরোসিন লন্ঠন (বিশ্বযুদ্ধকালীন), চষা ক্ষেতের চিহ্ন, সিলমোহর, নৌকার কঙ্কাল—মৃত নদীর গর্ভে কবরস্থ, কার্তুজের খোল, পোড়ামাটির খেলনা, শস্যদানা, একটি হাতঘরি (১টা বেজে ৫৩ মিনিট হয়ে থেমে আছে), মৈথুনচিত্র, রঙিন শার্সির কাচ, অচেনা যন্ত্রাংশ, একটি ঠিকানা-লেখা চিরকুট, এক কলঙ্কিত আলো, এক রাত্রির-ছোপ-লাগা ভোর…
এই বিক্ষিপ্ত অসংবৃত প্রত্ন-উপাদান থেকে গেঁথে উঠল একটি সম্পূর্ণ নতুন রচনা।‘… বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন https://www.ababhashbooks.com/dyanchinama-ekti-smritir-pratnasandhaan.html