‘জার্মানির বিখ্যাত প্রোটেস্টান্ট ধর্মতাত্ত্বিক রুডলফ অটো(১৮৬৯-১৯৩৭)১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা শুনে চমৎকৃত হয়েছিলেন এই কারণে যে—
আমাদের সামনে কোনো ধর্মতাত্ত্বিক প্রতর্ক উপস্থাপন করতে চাননি তিনি, কিংবা ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসের তত্ত্বনির্যাস নিয়ে কোনো বক্তৃতাও দিতে চান নি। চেয়েছিলেন তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত বোধকে মেলে ধরতে, আমাদের সেই বোধের অংশভাক করতে। সেই বোধ সম্পূর্ণই তাঁর নিজস্ব। ঐ বিশেষ ব্যক্তিসত্তা থেকে, তার বিশিষ্ট চরিত্র থেকে আলাদা করে নিয়ে, কখনোই তাকে সর্বজনীন করে তোলা যাবে না।
১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথের The Religion of Man প্রকাশিত হয়, যেটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত হিবার্ট লেকচারের গ্রন্থরূপ। বাংলা মানুষের ধর্ম বেরোয় এর দুবছর পরে।
অটোর সাক্ষ্য খুব তাৎপর্যময় এই কারণে যে তিনি আবার এক বিশেষ অর্থে বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান-ইতিহাসবেত্তা জোসেফ নীডহ্যামের(১৯০০-১৯৯৫) আত্মিক গুরু। তাঁর বহুপঠিত বই The Idea of the Holy (মূল জার্মান, ১৯১৭ ; ইংরেজি অনুবাদ, ১৯২৩) নীডহ্যামকে অল্পবয়সে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। পরিণত বয়সে নীডহ্যাম এতদূর পর্যন্ত বলেছিলেন যে শুদ্ধ-পবিত্রের জন্য মানবাত্মার যে-আকূতি, একমাত্র অটোই তার যথার্থ ব্যাখ্যা দিতে পেরেছেন।
নীডহ্যাম লিখছেন, ‘জীবন অনেক রূপের, অনেক রকমের স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতার’ সমাহার—সংমিশ্রণ নয়, সমাহার। সেইসব পরস্পরবিরোধী অভিজ্ঞতা মানুষের মধ্যে সহাবস্থান করে। সে সহাবস্থান তাঁর মতে মানবিক অস্তিত্বেরই একটা অঙ্গ। এইসব অভিজ্ঞতার মধ্যে কোনো একটিকে বা কয়েকটিকে অপরিহার্য বিবেচনা করে অন্যগুলিকে খাটো করা তাঁর মতে নিষ্প্রয়োজন। শিল্পসাহিত্য-বিজ্ঞান-দর্শন-ইতিহাস-নৈতিকতা-ধর্ম এসবই ব্রহ্মাণ্ড নামক এই ‘প্রকাণ্ড কাণ্ডে’ সাড়া দেওয়ার একেকটি পথ। সব পথ সবার জন্য সুগম নয়, অন্তত সমান সুগম নয়। এটা যে মানুষের অপূর্ণতা, সেকথা অবশ্য মানেন তিনি। স্পষ্টই জানান, মানুষের লক্ষ্য হল পূর্ণাঙ্গ আর পরিপূর্ণ হয়ে ওঠা, অর্থাৎ যে-ব্রহ্মাণ্ডে তার বসবাস তার প্রতি সাড়া দেওয়ার কোনো পথ থেকেই বঞ্চিত না হওয়া।
সেই পূর্ণতা অর্জন, সেই অখণ্ড সংস্কৃতি গড়ে তোলাই মানুষের চরম লক্ষ্য।
এই পূর্ণতালাভ, আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথেরও অন্বিষ্ট। কিন্তু ঠিক একই ভাবে নয়। দেবেন্দ্রনাথের প্রভাবমুক্ত রবীন্দ্রনাথের ধর্মচেতনায় যে বিবর্তন ঘটেছিল, তার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল প্রাতিষ্ঠানিকতার বন্ধনমোচন ও ব্যক্তিমানুষের নৈতিক মুক্তি। সেই বিবর্তনের পথে বিজ্ঞান তাঁর কাছে এক বড়ো আশ্রয় হয়ে ওঠে। তার সঙ্গে অন্য একটা উপাদানও মেশে এবং ক্রমে প্রবল হয়ে ওঠে : সেটা হল সৃজনশীলতা। সৃজন বলতে তিনি সেই জিনিসই বুঝতেন যা ব্যক্তিমানুষের মনের অদম্য তাড়নায় উৎসারিত- মার্কসের কথায়, যা মানুষের ‘আত্মিক উৎপাদন’ (spiritual production)। সেই আত্মিক তাড়নাতেই তা হয়ে ওঠে শুদ্ধ, পবিত্র, মালিন্যমুক্ত।
সেই তাড়নার নামই মানুষের ধর্ম। সে-ধর্ম কিন্তু একান্তভাবে ব্যক্তিমানুষেরই পালনীয়। প্রতিষ্ঠান সে-ধর্ম পালনের অন্তরায় শুধু নয়, বৈরি। ব্যক্তিমানুষের সেই ধর্মের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের সেতুবন্ধনের কাজে নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন উত্তরপর্বের রবীন্দ্রনাথ।…’ বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন https://www.ababhashbooks.com/rabindranath-manusher-dharma-manusher-bigyan.html