‘২০০৭ সাল, আমরা তখন লোনাকে, কাঞ্চনজঙ্ঘার উত্তর-পশ্চিম উপত্যকায়। হাড় হিম করা ঠাণ্ডা হাওয়া। বরফ পড়ার একটা আওয়াজ হয়েই চলেছে। রান্নার জন্য ডেকচিতে জল গরম হচ্ছে। নর-এর স্যুপের প্যাকেট কেটে রেখেছি। হঠাৎই ঝুপ করে আওয়াজ হল। পিছনে তাকিয়ে দেখি এক রাশ বরফ দরজার মাথার ওপর থেকে ঝরে পড়েছে। লাক্পা শেরপা আইস-এক্সটা নিয়ে দরজার মুখটা পরিষ্কার করতে লাগল। লোনাক ৪৭৮৫মিটার উচ্চতায় মূল কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমবাহের ঠিক পাশে। এবারেও দুপুরে লোনাকে পৌঁছনোর পর থেকেই ২০০৭ সালের যাত্রার কথা ভীষণ মনে পড়ছিল-- এখান থেকেই ফিরে গিয়েছিলাম গতবার। দশ দশটা বছর চলে গিয়েছে কালের নিয়মে কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আবার একই পথে আসা। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখবার স্বপ্ন মনে মনে জিইয়ে রেখেছিলাম। এবারও নিউ জলপাইগুড়ি, কাঁকরভিটা হয়ে বিরথামোড়, তারপর সওয়ারী গাড়ীতে তাপলেজং। চারজনের দল-- বেশ ভাল রকম তৈরি হয়ে এসেছি এইবার। গতবার লোনাক থেকে ফিরে গিয়ে একটা অসমাপ্ত গান বারবার বাজতে থাকত, ধাক্কা দিত ভীষণ আর মনে মনে শক্তি সঞ্চয় করতাম। মাঝে মাঝে বিষণ্ণ হয়ে পড়তাম-- আবার কি যাওয়া যাবে? ২০১৭ সালের প্রথম থেকেই ঠিক করে ফেলি ওপথে আবার যাব, তবে একটু অন্যরকম ভাবে যাব। এসব ভাবতে ভাবতে পন্ডিত শরৎচন্দ্র দাসের কথা মনে পড়ে গেল। আবারও পড়তে শুরু করলাম তাঁর লেখা বই-- জার্নি টু লাসা অ্যান্ড সেন্ট্রাল টিবেট, ১৯০২।
উচ্চ তামুরকোশী-র উপত্যকার কথা, কাঞ্চনজঙ্ঘার চারপাশের গ্রামগুলোর কথা, তিব্বত পৌঁছনো ও সেখানকার মানুষের জীবনচর্যার কথা পড়তে পড়তে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলাম। ঠিক করে ফেলি এবার উচ্চ তামুরকোশী উপত্যকার ওলাংচুঙ গোলা গ্রামটি দেখে তারপর ইয়াংমা উপত্যকায় কিছুটা এগিয়ে নাংগো-লা অতিক্রম করে চলে যাব মূল কাঞ্চনজঙ্ঘার উত্তর-পশ্চিম উপত্যকায়। দিনের হিসাব করে নিলাম। ২৫/২৬ দিন তো লাগবেই। আমি, মৃত্যুঞ্জয়, পিনু ও শান্তনু-চারজনই এক বাক্যে রাজি।
সিকিম-নেপাল সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম শিখর কাঞ্চনজঙ্ঘা (৮৫৮৬মি)। জরিপের অফিসের খাতায় কাঞ্চনজঙ্ঘার পূর্ব নাম ছিল ‘পিক ৯’। ‘পিক ৯’ পর্বতচূড়ার নামকরণ ও উচ্চতা মাপা হয়। তিব্বতি ভাষায় কাঞ্চনজঙ্ঘা কথাটির অর্থ হল তুষারের পাঁচ ঐশ্বর্য ভাণ্ডার বা পঞ্চ তুষারের ভাণ্ডার। বাঙালীর পর্যটন প্রেমের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে স্বর্ণচূড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা। ছোটোবেলা থেকেই দার্জিলিং, টাইগার হিল, সান্দাকফু বা সিকিমের নানা জায়গা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখে একটা আত্মীয়তা তৈরি হয়ে যায়, এক রোমান্সের জন্ম নেয়। কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গের তিনটি মূল শিবির স্থাপিত হয়। দুটি নেপালে আর একটি উত্তর সিকিমে। নেপালের দিকে, কাঞ্চনজঙ্ঘার উত্তর-পশ্চিম গাত্রের মূল শিবির তৈরি হয় পাঙপেমায়। ২০০৭ সালে যখন প্রথম এ পথে গিয়েছিলাম তখন কলকাতা—শিলিগুড়ি—কাঁকড়ভিটা--বিরথামোড়। তারপর বাস ধরে ফিদিম অবধি পৌঁছতে পেরেছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত অনির্দিষ্টকালের জন্য বনধ-এ আটকে গিয়েছিলাম ফিদিমে। অবশেষে চারদিন পর একটা নুনের লড়িতে চেপে তাপলেজং যেতে হয়েছিল। এবারে যেতে যেতে সে-সব কথা মনে পড়ছিল। ‘
বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন https://www.ababhashbooks.com/kanchenjunghar-anginaya-sharat-chandra-daser-pathe.html