শোনো কৃষ্ণপ্রসন্ন, আমি মৃত্যু। যদিও এখন অনায়াসে মৃত্যু শব্দটা উচ্চারণ করছি, কিন্তু জেনে রেখো, এই শব্দটা দূরে থাক, ‘ মৃত্যু’ ব্যাপারটা যে আসলে কী? আদিম মানুষ তার বিন্দুবিসর্গও জানতো না। তাড়া মনে করত, এই যে তার প্রিয় মানুষটি হাঁটাচলা করছে না, কথা বলছে না, খাওয়া-দাওয়া করছে না---এটা নিতান্তই একটা সাময়িক ব্যাপার---হয়তো এর পিছনে বিশেষ কোনো কারণ আছে যেটা সে জানে না বা বুঝতে পারছে না। সেটা কেটে গেলেই সে আবার আগের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। তাই তাকে কবর দেবার সময় তার মাথার কাছে, হাতের কাছে, পায়ের কাছে তার নিত্যব্যবহার্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রেখে দিত, যাতে জেগে উঠে তার কোনোকিছুর অভাব না ঘটে, কোনো অসুবিধে না হয়। এই মনোভাবেরই চূড়ান্ত পরিণতি মিশরের পিরামিড।
যাক সে কথা। যে-কথা তোমাকে বোঝাবার জন্য এত কথা বলতে হলো সেটা এবার বলে ফেলি---‘ মৃত্যু’ নেহাৎই একটি শব্দ---তোমাদের দেওয়া আমার নাম। আমাকে ওই নামে ডাকা হয়---এছাড়া তার সঙ্গে আমার কোনো সংশ্রব নেই।
এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক।
বুঝলে কৃষ্ণপ্রসন্ন, আমার অনস্তিত্বের গণনাতীত আয়ুষ্কালে এই প্রথমবার নিজের হয়ে সাফাই গাইতে বসেছি। জানি, এই অভূতপূর্ব ব্যাপারটা তুমি খুব উপভোগ করছ। ভাবছ, অপ্রতিদ্বন্দ্বী অপরাজেয় শতাধিক সমার্থশব্দে মানুষ যাকে সভয়ে স্মরণ করে, সেই কালান্তক যমের দোসর ‘মৃত্যু’-কেও শেষ অবধি অত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য এই দীর্ঘ জবানবন্দি নথীবদ্ধ করতে হলো। না, কৃষ্ণপ্রসন্ন, অত উল্লসিত হবার কোনো কারণ নেই। স্বতঃপ্রণোদিত এই জবানবন্দি আমি না দিলেও পারতাম। দিচ্ছি কেবল একটাই কারণে : অনাদি অনন্ত কাল থেকে আমার সন্বন্ধে বিশ্বসংসারের মানুষজন যে একটা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে আসছে---যার একজন শরিক স্বয়ং তুমিও---সেই হাস্যকর ভ্রান্তি নিরসনের তাগিদেই আমার এই কষ্ট স্বীকার।
সত্যি কথা বলতে কি, আমি সবচেয়ে অবাক হয়েছি তোমার একটা অদ্ভুত আচরণে। যমালয়ে বসে তুমি যখন ধর্মরাজকে তোমার খেরোর খাতায় লেখা কাহিনিগুলি পড়ে শোনাচ্ছিলে, তখন তোমার প্রতিটি প্রিয়জনের মৃত্যুর জন্যই তুমি যমরাজকে তথা আমাকে নির্বিবাদে দায়ী করে যাচ্ছিলে---সে- মৃত্যুর কারণ যা-ই হোক না কেন--- অসাবধানে জলে ডুবেই হোক কি আত্মহত্যা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা দুরারোগ্য ব্যাধি---বাঃ !
ইস্কুলে তুমি ছিলে বাংলার মাস্টার। মৃত্যু যে অতিপ্রচলিত ও নির্দিষ্ট অর্থবহ একটি বিশেষ্যপদ এবং জীবনের বিপরীতার্থক শব্দ, তা কিন্তু তোমার অজানা থাকার কথাই নয়---তাকে যে শতাধিক নানা-আকার-প্রকারের সমার্থ শব্দে ভূষিত করে তোমরা নিজেরাই নিজেদের ঘিরে রেখে অহরহ ভীত সন্ত্রস্ত হচ্ছ আর দায় তো সম্পূর্ণই তোমাদের।
একটা গাছ যখন শুকিয়ে যায়, তোমরা বলো ‘মরাগাছ’ বা ‘গাছটা মরে গেছে’। বাড়ির টেলিফোনটা বিকল হয়ে গেলেও তোমরা কত সহজেই বলো, ‘টেলিফোনটা ডেড’। পাহাড়ি রাস্তার শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালে---তার পরেই খাদ : বললে ‘ ডেড এণ্ড’ ! কোনো ঠিকানায় পাঠানো চিঠি---প্রাপক/প্রেরক কাউকেই না পেয়ে শেষ পর্যন্ত যখন ডাকঘরেই এসে জমা পড়ে যে-দপ্তরে তাকে বলো ‘ডেড লেটার অফিস’। কই, তখন তো আপাদমস্তকে শিহরন খেলে যায় না? কারণ ‘মৃত’ বা ‘মৃত্যু’ নিছক একটা শব্দমাত্র।
জীবনের শর্তই হলো মৃত্যু--- তার আলাদা কোনো তাৎপর্য নেই। জীবনকে ধরে রাখার জন্য শরীরে কতকগুলো কলকব্জা থাকে। সেগুলো যতক্ষণ সচল রাখতে পারবে ততক্ষণ তোমার আয়ু---না পারলেই ‘মৃত্যু’। বয়সের কোনো হিসেব সেখানে অচল। জননী বসুন্ধরা জীবের জীবনধারণের জন্য অঢেল আলো-বাতাস-জল-মাটি দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন এই চরাচর তার স্নেহের আঁচলে। ছিল অক্সিজেন—নাকে-মুখে টেনে নিয়ে ইঞ্চি কয়েক নীচে চালান করে দাও হৃদযন্ত্র পর্যন্ত---সে সচল থাকবে, তুমিও বেঁচে থাকবে---যতকাল চাও ততকাল।
যদি তা না পারো---সে দায় তোমার।
তোমরা বলো, ‘জীবনপ্রদীপ’। সে প্রদীপ যেমন বাতাসে নেভে, তেমনি তেল নিঃশেষ হলেও নিভবে। জীবনও তেমনি। তুমি তাকে বাঁচিয়ে রাখো না দমকা বাতাস থেকে, তেল যুগিয়ে যাও অনন্তকাল---সে-ও জ্বলতে থাকবে অনির্বাণ। তোমরা তা পারো না। নিজেদের অক্ষমতার দায় আমার ওপর চাপিয়ে দাও।
বললাম বটে অনন্তকাল কিন্তু অনন্তকাল কেউ বাঁচে না। মানুষ তো কোন ছাড়, এই যে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে তোমরা এখন আছ তার আয়ুও একদিন ফুরোবে।…
বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন ..