“২৬শে নভেম্বর। অন্তরাজ্যীয় স্থানান্তরণ ৩-এর বাতানুকুল পরিবেশ আর কৃত্রিম আলো থেকে বেরিয়ে খোলা চত্বরে পা রাখতেই কার্তিকের উজ্জ্বল সকাল দেখে আচমকা খুশিতে ভরে উঠল মন। সেখানে নাম-লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে অপেক্ষমাণ একসারি মানুষ। নিজের নামটা খুঁজে পেয়ে এগিয়ে যেতে বেড়ার ওপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন নীল স্যুটপরা কড়কড়ে যুবক।
জানা গেল, ইনি একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থার প্রতিনিধি, দুদিনের এই উৎসব পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন এঁরা। পার্কিং জোনের দিকে হেঁটে যেতে যেতে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন সেই প্ল্যাকার্ড, যা আসলে একটি স্বচ্ছ ফাইল। ভেতরে একগুচ্ছ কাগজ বিল ও ফ্লায়ার রয়েছে ।
–এর মধ্যে হোটেলের কাগজপত্র, অনুষ্ঠানসূচি, যোগাযোগের নম্বর সব আছে। আপনার সেশান বিকেল সাড়ে তিনটেয়। আপনি কি এখন হোটেলে যাবেন, নাকি সরাসরি অনুষ্ঠানস্থলে? লাঞ্চের ব্যবস্থা কিন্তু দু-জায়গাতেই রয়েছে।
সাদা উর্দিধারী চালক আমার হাতের ব্যাগটি নিয়ে ভরে দেন গাড়ির পেটে। তাজা স্নিগ্ধ বাতাস, সেদানের মাথায় কালো সান-রুফে চলকে উঠছে সূর্যালোক। মনটা ফের ফুরফুর করে ওঠে।
সোজা অনুষ্ঠানস্থলেই যাব, আমি জানাই। আরেকবার করমর্দন করে আমার সঙ্গী না হতে পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন নীল স্যুট। এক বিখ্যাত লেখকের নাম করেন, মিনিট কুড়ির মধ্যেই যাঁর আন্তর্জাতিক উড়ান এসে পৌঁছবে। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে হবে।
গাড়ি ছোটে ইন্ডিয়া হ্যাবিট্যাট সেন্টারের দিকে, আমি মুঠোফোন চালু করি। থরথর করে কেঁপে ওঠে ফোনটা, একসঙ্গে অনেকগুলো মেসেজ এসে ঢোকে। দিল্লির বাসিন্দা এক পুরোনো বন্ধু: জানাচ্ছে –যথাসময়ে অকুস্থলে পৌঁছে যাবে; সন্ধ্যাটা যেন খালি রাখি, আড্ডা হবে । জিগ্মে পাজো, আমার অনুষ্ঠানের সঞ্চালক: জানতে চেয়েছেন আমি কখন এসে পৌঁছচ্ছি, অনুষ্ঠান শুরুর আগে একটু বসে নেওয়া দরকার। আমার ভ্রাতুস্পুত্রী: কখন আসছ, কাকু? পরক্ষনেই তার ফোন বেজে ওঠে– ল্যান্ড করেছ?
শেষবার এসেছিলাম কয়েক বছর আগে, ইতিমধ্যে আরও বদলে গিয়েছে শহরটা। ফ্লাইওভার বেড়েছে, গাড়ি বেড়েছে। নতুন ইমারতের স্থাপত্যে, সাবওয়ের ম্যুরালে আরেকটু বিশ্বমানের হয়ে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা প্রকট হয়েছে চারিদিকে। আর এই সবকিছুর ওপর ছেয়ে আছে শীতসকালের অভাবনীয় রোদ আর অভাবনীয় নীলাকাশ। গাড়ির অনুচ্চ এফএম রেডিও জানায় শহরে আজ দিনের তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, বাতাসে ভাসমান কণার পরিমাণ ৩৬ মাইক্রোগ্রাম ।
ফোনে চেনা মানুষের বার্তা, চেনা কণ্ঠস্বরে কেমন একটা স্বস্তিবোধ হয়। সেটা হয়তো অস্বাভাবিক নয়। মাস তিনেক আগে এই নেমন্তন্নটা পাবার পর থেকেই একটা অস্বস্তি জমা হয়েছে মনের কোণে। ই-মেলে ফোনে যাদের সঙ্গে আমার আসা-যাওয়া-থাকা ও অন্যান্য খুঁটিনাটি বিনিময় হয়েছে, তাদের কাউকেই আমি চিনিনা । আমন্ত্রণের চিঠিতে উৎসবের অধিকর্তা হিসেবে যে দুই বিখ্যাত সাংবাদিকের নাম সাক্ষরিত ছিল, তাঁদের কারোর আমাকে চেনার কথাই নয় । তার মাত্র কিছুকাল আগে প্রকাশিত হয়েছে আমার একটি ইংরেজি বই, দেশের মূলধারার প্রকাশনা সংস্থা থেকে এই প্রথম। সেই বইয়ের সূত্র ধরে রাজধানীর নামী সাহিত্য উৎসবে আমন্ত্রণ, বিখ্যাত লেখকদের সঙ্গে এক পংক্তিতে অবস্থান, সাততারা হোটেলে রাত্রিবাস... প্রথম যৌবনে ঘটলে শুধুই আহ্লাদে আটখানা হতাম, ইংরেজিতে লেখার জাদু সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতাম, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত লেখক ভেবে ফেলতেও বাধা ছিল না। কিন্তু সেই কাঁচা বয়সটা যে পেরিয়ে এসেছি। তাছাড়া কিছুকাল ধরে অল্পবিস্তর লেখালিখির সুবাদে (তা সে হোক না এক দুস্থ আঞ্চলিক ভাষায়)এই ঘটনাক্রমগুলো কীভাবে ঘটে সে সম্পর্কে একটা ধারণাও হয়েছে।
আমার ইংরেজি বইয়ের বিষয় দার্জিলিং। সাত হাজার ফুট পাহাড়ের মাথায় এই শহরটা ঘিরে মধ্যবিত্ত বাঙালির যতই রোম্যান্টিক আবেগ থাক না কেন, এমনিতে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের আলাদা করে কোনো মাথাব্যথা নেই। সেটা অস্বাভাবিক কিছুও নয়। ভারতে নয় নয় করে এখনও প্রায় ডজনখানেক ছোটো বড়ো হিলস্টেশান আছে, তাদের অনেকেরই আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং চমকপ্রদ ইতিহাস আছে। সেসব নিয়ে আমাদের বাঙালিদের কীই বা আগ্রহ আছে? সে যাইহোক, বইটি যখন প্রকাশ পেল, ঘটনাচক্রে ঠিক তখনই দার্জিলিং পাহাড়ে নতুন করে বিক্ষোভের আগুন জ্বলল। একটি প্রান্তিক শৈলশহর আচমকা সংবাদের শিরোনামে উঠে এল। আমার বইটিতেও এসে পড়ল অপ্রত্যাশিত পাদপ্রদীপের আলো: অনেকগুলি সর্বভারতীয় পত্রপত্রিকায় রিভিউ হল, অংশবিশেষ ছাপা হল, কলাম লেখার বরাত এল। সাহিত্য উৎসবের কর্মকর্তাদের নির্ঘাৎ মনে হয়েছে, আরও পাঁচটা জনপ্রিয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ের সঙ্গে দেশের বিস্মৃত পূর্বপ্রান্তের এই গল্পটা, এই প্রান্তিক কণ্ঠস্বরটাও থাক। আমার অনুষ্ঠানের সঞ্চালক যথারীতি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের, পেশায় একটি বড়ো পত্রিকাগোষ্ঠীর সাংবাদিক। এটুকু শুধু জেনেছি, বাকিটা সাক্ষাতে জানব ।
ভাইঝি ফোনে জানালো, আজকের উৎসবের নির্ঘণ্ট কাগজে বেরিয়েছে; আমার অনুষ্ঠানটা হবে হ্যাবিট্যাট সেন্টারের সিলভার ওক লনে। একই সময়ে নাকি ভিন্ন ভিন্ন প্রোগ্রাম চলছে ভিন্ন ভিন্ন স্থলে।
গাড়ির সিটের পকেট থেকে উঁকি দেয় টাইমস অব ইন্ডিয়া , ভাঁজ খুলতেই তৃতীয় পাতায় দিনের সম্পূর্ণ নির্ঘন্ট। আমার অনুষ্ঠানের নামটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ– ‘ভয়সেস ফ্রম দ্য হিল্স: ব্রিঙ্গিং পেরিফেরি টু দি সেন্টার’। পরিধিকে কেন্দ্রে আনার আয়োজন! কে আনছে? কাকে আনছে? ওই সময় অন্য যে দুটি অনুষ্ঠান চলবে সেন্টারের অন্য দুটি জায়গায়, তার একটিতে রয়েছেন একজন অতীব গ্ল্যামারাস লেখক-কাম-রাজনীতিক। বিষয়টিও চিত্তাকর্ষক– ‘ক্রিকেট অ্যাজ ইন্ডিয়ান ডেমোক্রেসিস অল্টার-ইগো’। সেটা দেখে বেশ হালকা লাগে; খুব বেশি সংখ্যক শ্রোতা নিশ্চয়ই কেন্দ্র ছেড়ে পরিধির কথা শুনতে আসবে না। অতএব চাপ নেই কোনো। তবে তার আগে জিগমের সঙ্গে একটু বসে নিতে হবে। আর কতদূর?
ইতিমধ্যে গাড়িটা স্থবির শিকার-গেলা অজগরের পেটের মতো ট্রাফিকের ফাঁস থেকে বেরিয়ে ঢুকে পড়েছে ল্যুটেন সাহেবের পাড়ায়। দেশের সবচেয়ে আবিল ঘিঞ্জি শহরের পেটের মধ্যে আরেকটা শহর, যেখানে রাষ্ট্রের ভাগ্যনিয়ন্তারা থাকেন। প্রশস্ত নির্জন রাস্তা, ট্রাফিক আইল্যান্ড, পথের দুধারে বড়ো বড়ো গাছের সারি, তাদের পাতার ফাঁক দিয়ে ফুটপাতে এসে পড়েছে সূর্যের সোনালি পেন্সিল, ঘন বাগিচার ফাঁকে উঁকি দেয় দুধসাদা বাংলো ।
–এসি বন্ধ করে কাচ নামিয়ে দিলে হয় না? চালককে বলি ।
তিনি বোতাম টিপে কাচ নামিয়ে দেন, সেইসঙ্গে রেডিওর ধ্বনি একটু বাড়িয়ে দেন । একঝলক নির্মল বাতাস গাছপাতার ভেষজ গন্ধ নিয়ে এসে ঢোকে। এফএমে বাজছে বিজ্ঞাপন: বাচ্চার কাশির শব্দ, মায়ের গলা, শাসন করছেন ছেলেকে। ‘বিট্টু, কতবার তোমাকে বলেছি বিকেলে খেলতে বেরিও না, বাইরে কি পলিউশন। আবার তোমার কাশি শুরু হয়েছে, দেখেছ তো বেটা?’ এরপর অপর এক নারীকন্ঠ: 'কী হয়েছে মিসেস শর্মা? ডাঁটছ কেন বিট্টুকে?' প্রথম নারীকন্ঠ: 'আরে দেখ না, কতবার মানা করেছি এই পলিউশানের মধ্যে বাইরে খেলতে না বেরিও না, বেরিও না । কিন্তু ছেলে আমার কথা শোনেই না।' দ্বিতীয় নারীকন্ঠ: 'ওহ্ এই কথা। তাহলে বাড়িতে ডাইসন এয়ার পিউরিফায়ার লাগাচ্ছ না কেন? আমার মুন্না তো এখন বাড়ির মধ্যেই খেলে। যবে থেকে ডাইসন পিওরকুল এয়ার পিউরিফায়ার লাগিয়েছি, খেলা চালু, কাশি গায়েব। ডাইসন এয়ার পিউরিফায়ার – কুল এয়ার, পিওর এয়ার। টিংটং।’
বিমানবন্দরের বাইরে পা রাখার পর থেকেই মনটা এমন পালকের মতো হালকা ফুরফুরে হয়ে থাকার গূঢ় রহস্যটা এক ঝটকায় স্পষ্ট হয় আমার কাছে। ভুলে গিয়েছিলাম বেমালুম। এখানে আসার আগে বেশ কিছুদিন ধরে মনের মধ্যে যে উৎকন্ঠা পাক খাচ্ছিল, সেটা লিট-ফেস্টে এসে কী বলব কীভাবে বলব সেসব নিয়ে নয়; তার থেকেও ঢের মৌলিক: শ্বাস নিতে পারব কি?
তার কারণ বিগত প্রায় দু সপ্তাহ ধরে কালো বিষাক্ত ধোঁয়াশায় ঢেকে ছিল দিল্লির পরিবেশ, দিনের আলো দেখা যায়নি, সুস্থ সবল মানুষও বাইরে বেশিক্ষণ কাটালে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে, হাসপাতালে ডাক্তারের ক্লিনিকে উপচে পড়েছে ফুসফুসজনিত আর চোখের সমস্যায় ভোগা রোগীদের ভিড়, ইস্কুলগুলো বন্ধ করে দিতে হয়েছে, বয়স্কদের জন্য প্রাতঃভ্রমণ নিষিদ্ধ হয়েছে, স্বাস্থ্যদপ্তর থেকে নগরবাসীর জন্য প্রকাশিত হয়েছে একগুচ্ছ চেতাবনি, বিপর্যস্ত হয়েছে রেল ও বিমান পরিষেবা, অসংখ্য পথ দুর্ঘটনা ঘটেছে, বিদেশি দূতাবাসের কর্মীরা দেশে ফিরে গিয়েছে, বন্ধ হয়ে গিয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ। টিভিতে দেখেছি, দিনদুপুরে নেমে আসা থকথকে তমসার ভেতর হেডলাইট জ্বেলে চলেছে মন্থর শ্বাপদসম গাড়ির স্রোত। রাস্তার পাশে ঝাপসা নির্মীয়মাণ বহুতলের কংক্রিট খাঁচাগুলো দেখে মনে হয় বিশ্বযুদ্ধের পরেকার বিভীষিকা। টেলিভিশনে অনর্গল এইসব দৃশ্যের লাইভ সম্প্রচার করে গিয়েছেন গ্যাসমুখোশ-পরা টিভি সাংবাদিকেরা। যেন একটা পারমাণবিক যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
গাড়ির জানলায় অপস্রিয়মান লোধি গার্ডেনের নিবিড় গাছপালা, মখমল ঘাসে শীতের নরম রোদ্দুর, চাপা ট্রাফিকের শব্দ ছাপিয়ে ভেসে আসা পাখির কলতানে মাত্র কয়েকদিন আগের সেই বিভীষিকা মনে হয় যেন কোন সুদূরের অচেনা দুঃস্বপ্ন। এমনকি মাত্র কিছুক্ষণ আগে বিমানটা যখন রাষ্ট্রীয় রাজধানী ক্ষেত্রের (NCR) বায়ুমণ্ডলে এসে ঢুকল, যখন আদিগন্ত সবুজ সরে গিয়ে ভেসে উঠতে লাগল মাইল মাইল বিশুষ্ক ধূসর কংক্রিটের জঙ্গল, যা দেখে সিন্ধুসভ্যতার মৃতনগরীর যে ছবিটা মাথায় গিঁথে গিয়েছিল, সেও মনে হতে থাকে বুঝি স্বপ্নে-দেখা। প্রকৃতির এমনই জাদু। স্বাভাবিকতার এমনই অমোঘ শক্তি। নিজেদের সৃষ্টি করা ঘোর বিপর্যয়কেও মনে হয় তুচ্ছ, বিস্মরণযোগ্য, ও-কিছু-নয়।
ফাইলের ভেতর থেকে দু দিনের সাহিত্য উৎসবের সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানসূচি বের করে হাতড়াতে শুরু করি। সর্বমোট ৯৮জন বক্তা, ৭১টি অনুষ্ঠান, ছটি অনুষ্ঠানস্থল । বক্তাদের মধ্যে প্রাক্তন মন্ত্রী, সাংসদ থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা, অলিম্পিকে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ, চিত্রতারকা, খ্যাতনামা সমাজবিজ্ঞানী, নারীবাদী প্রকাশক ছাড়াও বিভিন্ন গোত্রের লেখক ও সাংবাদিকেরা রয়েছেন। পুরাণে নারীর স্থান থেকে শুরু করে ইসলামি ধর্মান্ধতা, বিজেপি শাসনের তিন বছরের খতিয়ান থেকে বলিউডের কাস্টিং কাউচ, কাশ্মীর থেকে শুরু করে দেশজ ও ভেষজ রান্না, বিখ্যাত কবির সাম্প্রতিক উপন্যাস থেকে গৃহপরিচারিকাদের অস্তিত্ব ও অধিকার, সাহিত্যে যৌনতা থেকে চন্দনদস্যু বীরপ্পনের শেষ মুহূর্তগুলি– বিবিধ বিচিত্র বিষয়ের মাথা-ঝিমঝিম-করা সমাহার। এর মধ্যে থেকে অনেক খুঁজে পরিবেশ সংক্রান্ত দুটি অনুষ্ঠান গোচরে আসে। তার মধ্যে একটি প্রাক্তন পরিবেশমন্ত্রীর সদ্যপ্রকাশিত বইকে কেন্দ্র করে, যার বিষয় ইন্দিরা গান্ধীর পরিবেশপ্রেম।
গাড়িটা এবার জোড়বাগ হয়ে ঢুকে পড়েছে লোধি রোডে। বাঁদিকে ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশানাল সেন্টারের প্রশস্ত লন, অডিটোরিয়াম, ডানদিকে আবহাওয়া দপ্তরের বাড়ি, দূরে ফুটে ওঠে হ্যাবিট্যাট সেন্টারের লাল ইঁটের উত্তরাধুনিক স্থাপত্য।
আচ্ছা, যদি এই দুদিন সেই দুঃস্বপ্নের ধোঁয়াশায় ছেয়ে থাকত দিল্লি শহর, তাহলে কী হতো? নিজেকেই প্রশ্ন করি আমি।
উত্তরটাও জানা। সেক্ষেত্রে এই বিপুল আড়ম্বরের সাহিত্য উৎসব নিশ্চয়ই মুলতুবি হয়ে যেত না। অনুষ্ঠানগুলো বাইরের উন্মুক্ত লন থেকে ভেতরে সরিয়ে নেওয়া হতো কেবল। সেন্টারের বিশাল বাড়িটায় অনেকগুলো বিভিন্ন আকারের প্রেক্ষাগৃহ রয়েছে। সেখানে বায়ুনিয়ন্ত্রিত বাতানুকুল পরিবেশে আলোচনা চলত ভেষজ রান্না, বীরপ্পনের শেষ মুহূর্ত কিংবা বেস্ট সেলার পুরাণকথা নিয়ে।
গাড়িটা সেন্টারের মূল ফটকের কাছাকাছি এসে গতি কমাতে হঠাৎ চোখে পড়ে যায়– দূরে আবহাওয়া দপ্তরের কম্পাউন্ডের ভেতর ঝোপঝাড় থেকে বেরিয়ে নীচু বেড়া টপকালো একটি ময়ূর। আচ্ছা, সেই বিষাক্ত দূষণের সময়টায় ল্যুটেনের দিল্লির এই পাখিগুলো কোথায় পালিয়েছিল? এখানে কিংবা রিজ এলাকার বনাঞ্চলে যেসব পাখি ভামবেড়াল শেয়াল বেজি আর কাঠবেড়ালিরা আছে, তারাই বা কী করছিল সেই দিনগুলোয়?
~
জলভরা পাত্রে রয়েছে একটি জীবন্ত ব্যাঙ। পাত্রর নীচে আগুন জ্বালানো হয়েছে। জল ধীরে ধীরে গরম হচ্ছে, ব্যাঙটিও সেই বাড়তে থাকা তাপমাত্রার সঙ্গে নিজেকে সইয়ে নিচ্ছে। এভাবে ক্রমশতাপ বাড়তে বাড়তে, সইয়ে নিতে নিতে একসময় সিদ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে ব্যাঙটি। এই গল্প আমরা জানি, এর নাম বয়লিং ফ্রগ সিনড্রোম। ব্যাঙটি চাইলে সময়মতো লাফ দিয়ে সেই জলপাত্র থেকে পালিয়ে যেতে পারত।
কিন্তু যদি বিকল্প না থাকে? যদি তেতে-ওঠা জলপাত্রটিই হয় আমাদের এই গ্রহ?
~
চার দশক আগে এই শহরেই একটি অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল এক তরুণের। দিনটা ছিল ১৭ই মার্চ, ১৯৭৮। এমনিতে দিল্লি এই সময়ে বেশ মনোরম; আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ, আকাশ ঝকঝকে থাকে। কিন্তু সেদিন দুপুরের পর অদ্ভুত মেঘলা হয়ে এসেছিল, এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গেল। সেই তরুণ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে এমএ ক্লাসের ছাত্র, লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে বাসার পথ ধরেছিলেন। পথে নামতেই মাথার ওপর বেজে উঠল গুরু গুরু ধ্বনি। তিনি ঘাড় ফিরিয়ে দেখলেন, আকাশে মিশমিশে কালো একখন্ড মেঘ আর তার নীচের দিকে একটি ধূসর টিউবের মতো অংশ চোখের পলকে সাঁই সাঁই করে বাড়ছে। পরমুহূর্তেই চাবুকের মতো আছড়ে পড়ল ঝড়। তরুণটি পড়িমরি ছুট দিয়ে একটি বাড়ির নীচু বারান্দা দেখতে পেয়ে লাফিয়ে তার রেলিং টপকে মেঝেয় শুয়ে পড়লেন উপুড় হয়ে। ইতিমধ্যে ধেয়ে এসেছে সেই প্রবল গর্জন। দেহটা মেঝেয় যথাসম্ভব লেপটে দিয়ে মাথা তুলে দেখলেন রাস্তায় বইছে এক অবিশ্বাস্য ধূসর ধুলোর প্লাবন, আর তার মাথায় ভেসে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে সাইকেল স্কুটার ল্যাম্পপোস্ট টিনের চাল এমনকি আস্ত একটা চা-গুমটি। হাওয়ার দাপট বুঝি দৈত্যের মতো তাঁর পিঠের জামা খামচে ধরে মাটি থেকে টেনে তুলতে চাইছিল।
কয়েক মিনিট চলেছিল। ঝড় থামলে দেখা গেল একটি সরু নির্দিষ্ট এলাকা দিয়ে গিয়েছে সেই ধ্বংসের তান্ডব। সেদিন শহরে তিরিশজন মানুষ মারা গিয়েছিল, সাতশোজন গুরুতর আহত হয়েছিল, অসংখ্য বাড়ি ভেঙে পড়েছিল, যমুনায় জলোচ্ছাস হয়েছিল কুড়ি-তিরিশ ফুট উঁচু। এছাড়া মাত্র কয়েক মিনিটের সেই রহস্যময় ঝড়ের পথে একটি গাছও আস্ত দাঁড়িয়ে ছিল না ।
এই অভিজ্ঞতা গভীর রেখাপাত করবে সেই তরুণের মনে, চার দশক পরে তিনি লিখবেন তার কথা।
~
মহা অবিন্যাস
ভীষণভাবে বদলে যাওয়া বিশ্বে, যখন সমুদ্রতল উঠে এসে সুন্দরবনকে গ্রাস করেছে এবং কলকাতা, নিউ ইয়র্ক ও ব্যাংককের মতো শহরগুলো আর বাসযোগ্য নেই, যখন সেই অনাগত ভবিষ্যতের পাঠক ও মিউজিয়ামের দর্শকরা আমাদের এইসময়ের শিল্পসাহিত্যের দিকে তাকাবে, তারা কি প্রথমেই ব্যাকুলভাবে সেই বদলে-যাওয়া বিশ্বের, যা তারা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে, আগাম ইশারাগুলো খুঁজবে না? আর যখন সেগুলো খুঁজে পাবে না, তখন তারা আর কীই বা করতে পারে? তারা কেবলমাত্র একটিই সিদ্ধান্তে আসতে পারে: আমাদের এই বর্তমান সময়ে শিল্পসাহিত্য নানান লুকোছাপার আশ্রয় নিয়েছে, যা মানবসমাজকে ঘনায়মান বিপর্যয় চিনে নিতে বাধা সৃষ্টি করেছে। তখন এটা খুবই সম্ভব যে আমাদের এই যুগ, যা সারাক্ষণ আত্মসচেতনতার দোহাই দিয়ে নিজের পিঠ চাপড়ে চলে, চিহ্নিত হবে এক মহা অবিন্যাসের যুগ হিসেবে ।(অমিতাভ ঘোষ)
~
দ্য গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট– আক্ষরিক বাংলা করলে মহা অবিন্যাস। তবে এখানে অবহনন কথাটা হয়তো বেশি লাগসই। বিন্যাস হল প্রকৃতির নিজের সৃষ্টি করা ভারসাম্য, অন্যদিকে অবহননে মানুষের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর যথেচ্ছ হস্তক্ষেপের কারণে যে বিপর্যয় ডেকে এনেছি আমরা বিগত দুই শতাব্দীতে, তাকে অবহনন ছাড়া আর কীই বা বলা যায়?
এই অবহননের কথাই লিখেছেন সেদিনের সেই ঝড়-ফেরতা তরুণ, লেখক অমিতাভ ঘোষ তাঁর দ্য গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট বইতে। এত বড়ো একটা বিষয়, এই গ্রহের সব মানুষ ও জীবের বেঁচে-থাকা যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তার চর্চা আমাদের একালের সাহিত্যে সংস্কৃতিতে আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত, যা দেখে ভাবীকালের পাঠকেরা আমাদের এই সময়কালকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করবে। অমিতাভ আমাদের দেখান এই মানসিকতা গড়ে ওঠার পেছনে শিল্পসাহিত্যের কী ধরণের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা রয়েছে।
~
আকাঙ্ক্ষার জন্ম
সংস্কৃতি আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়– গাড়ি ও যান্ত্রিক সরঞ্জামের প্রতি, বিশেষ ধরণের বাগান ও বাসস্থানের প্রতি, যা হল কার্বন অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। একটি দ্রুতগামী মোটরযান আমাদের মধ্যে যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে সেটা আমরা ধাতু বা রং ভালোবাসি বলে নয়, এর যন্ত্রবিদ্যা সম্পর্কে কোনো ভাসা-ভাসা ধারণা থেকেও নয়। আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়ি, কারণ ওই যন্ত্রযানটি আমাদের মনে উসকে তোলে একটি রাস্তার ইমেজ, যা এক অনাবিল নিসর্গের ওপর দিয়ে তীরের মতো ছুটেছে; আমাদের মনে ভিড় করে আসে উদ্দাম মুক্তি আর চুলে হাওয়ার খেলা; আমরা যেন দেখতে পাই জেমস ডিন আর পিটার ফন্ডা ধেয়ে চলেছেন দিগন্তের দিকে; আমাদের মনে পড়ে যায় জাক কেরুয়াক আর ভ্লাদিমির নবোকভের লেখাও।
এভাবেই কোনো বিজ্ঞাপনে ক্রান্তীয় অঞ্চলের একটি দ্বীপের ছবি আর তার ওপরে লেখা ‘প্যারাডাইস’ শব্দ মনের মধ্যে পরপর যে কামনাশৃঙ্খল গেঁথে তোলে, তা এমনকি ড্যানিয়েল ডিফো কিংবা জাঁ জাক রুশো পর্যন্তও বিস্তৃত হতে পারে। এভাবেই আবু ধাবি বা দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার মতো উষর এলাকায়, যেখানে চিরকাল মানুষ জলের পরিমিত ব্যবহারে সামান্য আঙুর কিংবা উদ্ভিদ ফলিয়ে এসেছে, সেখানে গ্যালন গ্যালন পরিস্রুত জলে ধোয়া সবুজ লন এমন এক আকাঙ্ক্ষার বিজ্ঞাপন হয়ে উঠতে পারে যার আঁতুড়ঘর হল জেন অস্টেনের উপন্যাস।(অমিতাভ ঘোষ)
~
দিনের পর দিন কালো বিষাক্ত ধোঁয়াশায় ঢেকে ছিল দেশের যে রাজধানী শহর, সেখানে তার অব্যবহিত পরেই চিন্তা-চেতনা-ভাবনা বিনিময়ের দুদিনের বিশাল সাহিত্য উৎসবে ছটি অনুষ্ঠানস্থল জুড়ে আটানব্বইজন বক্তা ও একাত্তরটি সেশনে মাত্র দুটি অনুষ্ঠান হল প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে । তার কয়েকদিন আগেই আমি শেষ করেছি দ্য গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট । বইটির মূল প্রতিপাদ্য আর লিট-ফেস্টের এই ব্যাপারটা খাপে খাপে বসে গেল যেন। সত্যিই কি প্রকৃতি, পরিবেশ, বিশ্বউষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যতটা লেখা হওয়া উচিৎ তা হচ্ছে না? অথবা যা কিছু চর্চা সবই হচ্ছে বৈজ্ঞানিক বিশেষজ্ঞ মহলে, আকাদেমিক জ্ঞানভান্ডার হয়তো ভরে উঠছে, কিন্তু সাধারণ পাঠকের নাগালযোগ্য সাহিত্যে ব্রাত্য হয়ে থাকার জন্য বৃহত্তর লোকসমাজে পৌঁছচ্ছে না? আমি খুঁজতে শুরু করলাম ।
অমিতাভ অনুযোগ করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি একালে সাহিত্যাশ্রয়ী উপন্যাসের বিষয় হয়ে ওঠেনা। এব্যাপারে সাহিত্য সমালোচনার একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির কথাও বলেছেন তিনি। লন্ডন রিভিউ অব বুক্স, নিউ ইয়র্ক টাইমস রিভিউ অব বুকস, কিংবা লিটারারি জার্নাল– এর মতো বিশ্ববিখ্যাত পত্রপত্রিকাগুলি উল্লেখ করে দেখিয়েছেন, যখনই জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কোনো বইয়ের সমালোচনা চোখে পড়ে, সেসব অবধারিতভাবেই হয় ননফিকশন গদ্য। ক্বচিৎ উপন্যাসে এই বিষয়টি উপজীব্য হলে তাকে নির্বাসন দেওয়া হয় সায়েন্স ফিকশনের বিভাগে– যেন সাহিত্যিক কল্পনায় জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয় ভিনগ্রহের প্রাণী কিংবা নক্ষত্রযাত্রার সমগোত্রীয়।
এটা কিন্তু বেশ অদ্ভুত। কোনো বিষয়ের গুরুত্ব যদি তার আশু প্রভাব এবং ব্যাপ্তির সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, সেক্ষেত্রে সভ্যতার ভবিষ্যৎ জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে এই একটি বিষয় বিশ্বজুড়ে সাহিত্যিকদের প্রধান চর্চার বিষয় হওয়া উচিৎ।
কিন্তু বাস্তবে সেটি ঘটছে না।
কেন ঘটছে না? অমিতাভ জানতে চেয়েছেন। বিশ্ব উষ্ণায়নের গতিপ্রকৃতি কি এতটাই বন্য যে তাকে প্রচলিত সাহিত্যিক বয়ানে ধরা যাচ্ছে না? ধরা যাক, এক বসন্তের দুপুরে দিল্লিতে যে আচম্বিত ঝড় তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তাকে উপন্যাসে ব্যবহার করলে বড়ো বেশি আজগুবি মনে হবে? এমন এক উৎকণ্ঠার কথাই সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ বলেছেন চতুরঙ্গ উপন্যাসে, যদিও সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গে: ‘গল্পই লোকের বিশ্বাস কাড়িবার জন্য সাবধান হইয়া চলে। সত্যের সে দায় নাই বলিয়া সত্য অদ্ভুত হইতে ভয় করে না।‘
আজ এই বিষয়ে আর কোনো দ্বিমত নেই যে আমরা এমন এক সময়কালে ইতিমধ্যে প্রবেশ করেছি যেখানে এই বন্যতাই এখন স্বাভাবিক। বিশ্ব জুড়ে নিয়মিত ঘটে চলা সাইক্লোন, অস্বাভাবিক তাপপ্রবাহ, অপ্রত্যাশিত তুষারপাত, বন্যা ও ঋতুর খামখেয়ালিপনার দিকে লক্ষ করলেই সেটা মালুম হয়। সাহিত্য যদি এই বাস্তবকে ধরতে না পারে, তাহলে সেটা হবে তার ব্যর্থতা ।
এবং এই ব্যর্থতার জন্য একালের লেখকদের অংশত দায়ী করেছেন অমিতাভ। এমনকি তিনি নিজেকেও বাদ রাখেননি; পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দীর্ঘদিনের ভাবনাচিন্তা সত্ত্বেও তাঁর উপন্যাসে এই বিষয়টা সেভাবে আসেনি, সেটা কবুল করেছেন। (যদিও আমরা জানি, তাঁর দ্য হাংরি টাইড উপন্যাসের শেষ পর্বে সাইক্লোন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে এসেছে)। অরুন্ধতী রায়ের মতো শক্তিশালী লেখক পরিবেশ নিয়ে তাঁর যাবতীয় জ্ঞান ও উৎকণ্ঠা ননফিকশন গদ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন, সে কথাও বলেছেন আক্ষেপের সুরে।
এবং এসবের থেকে একটি উপলব্ধিতে এসে পৌঁছেছেন অমিতাভ, লিখছেন– জলবায়ুর সঙ্কট হল সংস্কৃতিরও সঙ্কট, অর্থাৎ কল্পনার সঙ্কট।
অমিতাভ ঘোষের এই কথাগুলিকে জপমালা করে পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের ভূমিকা নিয়ে সাম্প্রতিক কালের লেখালিখি খুঁজতে বেরিয়ে কিন্তু ভিন্ন এক উপলব্ধিতে এসে পৌঁছলাম আমি: এই বিষয়গুলো নিয়ে, অথবা ছুঁয়ে, লেখালিখি হচ্ছে, প্রচুর পরিমাণে হচ্ছে, এবং সাধারণ পাঠকের কথা মাথায় রেখেই হচ্ছে। সেখানে কল্পনার স্ফূরণ যেমন চোখে পড়ার মতো, তেমনই তাদের সাহিত্যমূল্যও যথেষ্ট। ছকে-বাঁধা গল্প উপন্যাস হয়তো সেভাবে লেখা হচ্ছে না, যতটা হতে পারত। এক্ষেত্রে সদ্যপ্রয়াত বিদ্যাধর সুরজপ্রসাদ নইপলের কথা হয়তো প্রাসঙ্গিক হতে পারে। নইপল একাধিক জায়গায় সখেদে বলেছেন– প্রচলিত ফর্মে উপন্যাস হল উনিশ শতকের বিলুপ্ত স্মারক, যা আজকের সময়ের জটিল স্তরবহুল বাস্তবকে সেভাবে ধরতে পারে না। তাঁর এই মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে, কিন্তু এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে গদ্যসাহিত্য প্রচলিত ছক ছাপিয়ে যাবার নেশায় মেতেছে। বিশ্বজুড়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ লেখকের হাতে উপন্যাসের সংজ্ঞা প্রসারিত হয়েছে, বিভিন্ন গোত্রের ফর্ম আত্মস্থ করেছে উপন্যাস,ফিকশন আর ননফিকশনের মাঝে আলোআঁধারি অঞ্চলগুলোয় অভিনব অনুসন্ধান হয়েছে। হোর্হে লুই বোর্হেস কিংবা উইনফ্রিড গিয়র্গ সেবাল্ডের মতো লেখকদের রচনায় গোত্রনির্ধারণের এক সচেতন প্রত্যাখ্যান (সেবাল্ডের বইয়ের পেছনের মলাটে লেখা থাকে– মেমোয়ার, ট্রাভেলগ, হিস্ট্রি, ফিকশন)সেই কথাই মনে পড়িয়ে দেয় আমাদের ।
সে যাইহোক, মোদ্দা কথা হল প্রকৃতি পরিবেশ ও মানুষের ভূমিকা নিয়ে সরাসরি কিংবা অপ্রত্যক্ষভাবে অসাধারণ ভাষায় ভঙ্গিতে লিখে চলেছেন এক ঝাঁক লেখক। তাঁদের কারোর কারোর লেখা ইতিমধ্যেই ক্লাসিক হিসেবে গণ্য হয়েছে, অসংখ্য পাঠকের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। কারোর ক্ষেত্রে সেটা হয়নি, কিন্তু হবার দাবি রাখে। এঁদের লেখায় ফুটে উঠেছে এই বিশ্বের প্রকৃতি ও পরিবেশ নিয়ে তীক্ষ্ণ আসক্তি, প্রেম, এবং আমাদের এই সভ্যতার ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উৎকণ্ঠা । এঁরা যেন সেই হারিয়ে-যাওয়া ডোডো পাখি, গান গাইছেন বিভিন্ন ভাষায়, কিন্তু সেই গান হারিয়ে যাচ্ছে কর্কশ ধাতব মিছে কোলাহলে। বিলুপ্তির কিনারে দাঁড়িয়ে আমরা শুনতে পাচ্ছি না, শুনতে চাইছি না।
সেইসব রচনার থেকে নানান টুকরো ছুঁয়ে ছেনে এক উৎকন্ঠার ভাষ্য গেঁথে তোলা হয়েছে এই বইতে। সবকটি অংশই ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছি; তার মধ্যেই কয়েকটি আবার অন্য ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনূদিত। পরিবেশ ও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে ইংরেজি ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য ভাষায় ভিন্ন ধারার গদ্যসাহিত্যের সন্ধান মিলেছে, কিন্তু অনুবাদের অভাবে সেগুলি আমার নাগালে আসেনি। লক্ষ করার মতো একটি বিষয় হল, যত লেখকের লেখার অংশ এখানে ব্যবহার করেছি (প্রায় চল্লিশ জন), তাঁদের মধ্যে অনেকেই মার্কিন দেশের। তার একটি কারণ– সংখ্যা ও বৈচিত্র্যের নিরিখে গোটা বিশ্বে বই প্রকাশনার সিংহভাগ দখল করে আছে আমেরিকা, ফলে পরিবেশ নিয়ে উচ্চমানের বইও ওই দেশে থেকেই আসবে সেটা কিছু অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সম্ভবত সেটাই সব নয়। আমেরিকা হল এক দেশ যার একদিকে যেমন অপার ভূপ্রাকৃতিক ঐশ্বর্য রয়েছে, অন্যদিকে এই দেশটা এমন এক সংস্কৃতি ও জীবনধারার জন্ম দিয়ে চলেছে, বিশ্ব পরিবেশের ওপর যার পরিণাম মারাত্মক। ফলত, পরিবেশ নিয়ে স্মৃতি স্বপ্ন উৎকণ্ঠা সেই দেশের চিন্তাশীল মানুষের কল্পনাকে আচ্ছন্ন করতে বাধ্য।
এখানে আমাদের অবশ্য দেশ ভাষা বা অঞ্চলের নিরিখে প্রতিনিধিত্বমূলক লেখা বাছার কোনো দায় নেই, কারণ এই বইটি কোনো সংকলনগ্রন্থ নয়। বিভিন্ন লেখকের রচনায় ছড়ানোছিটানো যে টুকরোগুলো চয়ন করা হয়েছে, সেগুলিকে গেঁথে গেঁথে যে একটি ব্যক্তিগত পাঠ নির্মাণের চেষ্টা হয়েছে, তার বাইরেও রয়ে গিয়েছে অসংখ্য মণিমুক্তো। ভাষ্য থেকে অনূদিত অংশগুলির স্বাতন্ত্র্য বোঝানোর জন্য একটি করে উপশিরোনাম দেওয়া হয়েছে, এবং বন্ধনীর মধ্যে রয়েছে সেই অংশটির লেখকের নাম । এইভাবে –
~
বেরিয়ে এল সবজেটে একটি স্তর
আমি যে জঙ্গলটায় কাজ করি, অনেক বছর আগে একবার সেখানে এক জায়গায় অনেকগুলি প্রাচীন বিচ গাছের মাঝে কিছু অদ্ভুত দর্শন পাথর দেখতে পেয়েছিলাম। বহুদিন ধরেই আমি ওই জায়গাটা দিয়ে গিয়েছি, কিন্তু কখনো পাথরগুলো নজরে পড়েনি। সেদিন আমি থেমে ঝুঁকে পড়ে খুঁটিয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। পাথরের আকার ভারি বিচিত্র, বাঁকানো আর মধ্যিখানগুলো খুবলে নেওয়া। সাবধানে আমি পাথরের গা থেকে শ্যাওলার আস্তরণ সরালাম। দেখি নীচে গাছের বাকল রয়েছে। পকেট ছুরিটা বের করে খানিকটা বাকল চেঁছে নিতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল সবজেটে একটি স্তর। সবুজ? কিন্তু এই রংটা তো দেখতে পাওয়া যায় কেবলমাত্র ক্লোরোফিলের মধ্যে, যা নতুন পাতাকে সবুজ করে! জীবন্ত গাছের কান্ডের মধ্যেও অবশ্য ক্লোরোফিলের সঞ্চয় থাকে। এর থেকে একটিই ব্যাপার হতে পারে : কাঠের এই টুকরোটি জীবন্ত। হঠাৎ আমার গোচরে এল বাদবাকি ‘পাথর’গুলোও একটি সুনির্দিষ্ট বিন্যাসে রয়েছে– প্রায় ৫ ফুট ব্যাসের একটি বৃত্ত। সেদিন আমি যা খুঁজে পেলাম সেটি আর কিছুই নয়, এক বিশাল সুপ্রাচীন বনস্পতির গিঁটপাকানো অবশেষ। তার বাইরের খোলশের চিহ্নটুকুই কেবল পড়ে রয়েছে। বহুকাল আগে কান্ডের ভেতরের অংশ পচে মাটি হয়ে গিয়েছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে গাছটি অন্তত চারশো কি পাঁচশো বছর আগে মাটিতে পড়েছিল। কিন্তু তার এই সামান্য অবশিষ্টটুকু এতকাল ধরে জীবিত আছে কীভাবে? জীবন্ত কোষের চাই খাদ্য, শর্করার রূপে, তাদের শ্বাস নিতে হয়, এবং খুব সামান্য হলেও বৃদ্ধি হয়। কিন্তু পাতা ছাড়া– অর্থাৎ কিনা সালোকসংশ্লেষ ছাড়া– সেটা অসম্ভব। আমাদের এই গ্রহে কোনো প্রাণই শতাব্দীব্যাপী অনাহারে থাকতে পারে না। এমনকি একটি গাছের অবশিষ্টও না; ভূমিতে থাকা কান্ডের কাটা অংশ তো কোনোভাবেই নয়। স্পষ্টতই এই গুঁড়ির অংশটিতে কিছু একটা ঘটছিল। আশেপাশের গাছগুলো থেকে সে কোনোভাবে সাহায্য পাচ্ছিল, বিশেষ করে তাদের শিকড়ের থেকে।(পিটার উলেহ্বেন)
~
এভাবেই পিটার, জার্মানির একজন অরণ্যরক্ষী, আবিষ্কার করলেন বনের মধ্যে মাটির নীচে বার্তা বিনিময় করে গাছেরা। এবং সেই আশ্চর্য কান্ডটা ঘটে শিকড়ে শিকড়ে বৈদ্যুতিক স্পন্দনের মারফৎ, অথবা সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম ছত্রাককণার সাহায্যে । একে তিনি বলেছেন উড ওয়াইড ওয়েব, যা অনেকটা ইন্টারনেটের ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব-এর মতো, যা আমাদের অগোচরে মাটির নীচে বিছানো রয়েছে। কোনো একটি গাছে তৃণভোজী প্রাণী আক্রমণ করলে অন্যান্য গাছেরা সেটা তৎক্ষণাৎ জেনে যায়, এবং ওদের নিরস্ত করার জন্য পাতায় পাতায় এক ধরণের তিক্ত রাসায়নিক পাঠাতে শুরু করে। কোনো গাছ অসুস্থ হলে, মৃতপ্রায় হলে, শিকড়ের মারফৎ তার শুশ্রূষা করতে থাকে। এভাবেই বহু শতাব্দী আগে ধূলিসাৎ হওয়া ওই বিচের অবশেষটিকে প্রয়োজনীয় খাদ্য জোগাচ্ছিল আসেপাশের গাছেরা। তাঁর এই অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার নিয়ে সম্প্রতি বই লিখেছেন পিটার – গাছেদের গুপ্ত জীবন ।
এক অর্থে আমাদের এই বইটিও নানান গাছের অরণ্য। এখানে বিভিন্ন অংশগুলি পাতার মতো একে অপরের সঙ্গে ফিসফাস কথা বলছে সাংকেতিক ভাষায়। ডোডো পাখিদের গানে মুখরিত এই অরণ্যে বিছানো জালের মতো আলোছায়াময় পথ। আমরা যে যার নিজের মতো পথ করে নিয়ে চলতে পারি।“
পরিমল ভট্টাচার্য, ‘ডোডোপাখিদের গান: পরিবেশ মানুষ ‘সভ্যতা’ এবং…’, অবভাস।
বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন https://www.ababhashbooks.com/dodopakhider-gaan-poribesh-manush-sovyota-ebong.html