“…বইয়ের আকৃতি, প্রচ্ছদ, হরফ ইত্যাদি দিকেও যে কবির সযত্ন মনোযোগ ছিল সে কথা অনেকেই জানেন। ১৩১৫ সনের আশ্বিন মাসে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ করেন শারদোৎসব নাটক। রেশমে বাঁধানো বইটির মলাটে ছিল বলাকা ও কাশগুচ্ছের ছবি। কার্ত্তিক মাসে ভারতী পত্রিকায় বইয়ের ‘বাহ্য চাকচিক্য ও মুদ্রণের পরিপাট্য’ সম্পর্কে সপ্রশংস মন্তব্য করা হয়। বইটি ‘শোভন রূপে ছেপে প্রকাশ করার জন্য’ চারুচন্দ্রকে শান্তিনিকেতনে ডেকে পাঠান রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। কবির অনুরোধ রাখতে চারুচন্দ্র যে-উদ্যোগ নিলেন তা তাঁর নিজের জবানিতে শোনা যাক: ‘ইহাকে লোচন-রোচন করিবার জন্য ইহার আকার করি একটু নূতন ধরনের,-প্রাচীন পুঁথির আকারে এবং আমি নিজে গিয়া অনুরোধ করিয়া প্রসিদ্ধ চিত্রকর যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়কে দিয়া ইহার প্রচ্ছদের ও মুখপাতের জন্য দুইখানি চিত্র অঙ্কিত করাইয়া লই।‘
এভাবে অনেক উদাহরণের কথাই ভাবা চলে। জার্মানিতে ফ্যাকসিমিলি ছাপার কৌশল দেখে তাঁর উৎসাহ ও সেই উৎসাহের জেরে লেখন-এর পরিকল্পনা, মুদ্রণ সংস্কৃতির সঙ্গে তাল রেখে হরফ ও বানান সংস্কারে তাঁর উদ্যম, বিশ্বভারতীর প্রকাশনায় বাংলায় সর্বপ্রথম হাউস স্টাইল প্রবর্তনের চেষ্টা, ছোটোদের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে তাঁর মৌলিক ভাবনা, ছবিকে ঘিরে বইয়ের টেক্সট নির্মাণ- যেমন তিনি ‘সে’ রচনা সময় করেছিলেন, এবং সর্বোপরি কবিতা ছাপার সময় পৃষ্ঠায় হরফ, ফাঁক, মার্জিন ও ইনডেন্টের অভিনব বিন্যাস- এ সমস্তের মধ্যেই মুদ্রণের প্রযুক্তি ও ছাপা বইয়ের বহিরঙ্গের সৃজনক্ষম সম্ভাবনাগুলি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নিরন্তর অনুশীলনের সাক্ষ্য খুব স্পষ্ট। আমাদের সংস্কৃতির আরও অন্য অনেক কিছুর মতো ছাপা বই সম্পর্কে বাঙালির রুচিবোধ ব্যপক অর্থে রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী। দূরস্থিত কৃতসংযম রূপের অন্তরে তিনি চারিয়ে দিতে জানতেন এক ধরনের ইন্দ্রিয়-সংবেদী শ্রী। ‘লোচন-রোচন’ ছাপা বইয়ের মধ্যে বাঙালি পাঠক আজও সেই মিতাচারের বিলাস খোঁজেন।
এর সঙ্গে অবশ্যই যোগ করতে হবে শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর কর্মকাণ্ডে মুদ্রণকে সাঙ্গীকৃত করার জন্যে তাঁর চেষ্টা। ১৩২৩ সনে নেব্রাসকার ওমাহা শহরে সফরের সময় তিনি বার্নহার্ট ব্রাদার্স
অ্যান্ড স্পিন্ডলার কোম্পানিকে বরাত দেন টাইপ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি শান্তিনিকেতনে পাঠাতে। ৫৪০ ডলার দামের সেই সরঞ্জাম যুদ্ধের কারণে পৌঁছতে কিছু দেরি হয়েছিল। এর আগে লিংকনে তিনি একটি মুদ্রণযন্ত্র উপহার পান, তাঁর জন্যেই ওই সরঞ্জাম কেনা। ছাপার ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করার জন্য ১৩২৫ সনের আষাঢ় মাসে শান্তিনিকেতন আসেন সুকুমার রায়। ওই বছর আশ্বিন মাসেই শান্তিনিকেতন প্রেসের ছাপা প্রথম বই গীতপঞ্জাশিকা প্রকাশ পায়। সাঁওতাল বিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে কলকাতায় পাঠানো হয় বাঁধাইয়ের কাজ শিখতে। আশ্বিন মাসের শেষ দিকে ২৫০০ টাকা দিয়ে আরও একটি ছাপা মেশিন কেনা হয়েছিল। এসব কাজের উদ্দেশ্য হয়তো ছিল বিদ্যালয়ের খরচ কমানো এবং রোজগার বাড়ানো, কিন্তু উদ্দেশ্যসাধন না হলেও রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ কমেনি। ১৩২৫ সনের অগ্রাহায়ণ মাসে শান্তিনিকেতন প্রেসে ছাপা তাঁর দ্য ফিউজিটিভ বইটির একটি কপি পিয়ারসনকে পাঠান তিনি। সঙ্গের চিঠিটিতে ঠাট্টা করে লেখেন:
The book has been printed in that press which we got from Lincoln. It is too small for regular printing business, so, like that gift of a diamond stud to a man whose shirt was of a poor quality, it has necessitated further expenditure, far exceeding its own value…
পরে এ কথাও জুড়ে দেন যে, বইয়ে ছাপার ভুলের সংখ্যা দেখে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয় বইটা নিমাই, বিষ্ণু এবং আরও কয়েকজন আশ্রমের ছাত্র তথা কম্পোজিটারের কীর্তি, শান্তিনিকেতন প্রেসের খাঁটি জিনিস।…”
স্বপন চক্রবর্তী সম্পাদিত, ‘রবীন্দ্রনাথ: শিল্পরূপ-পাঠরূপ-গ্রন্থরূপ’, ‘অবভাস’
স্বপন চক্রবর্তী অবসরপ্রাপ্ত জাতীয় গ্রন্থাগারের ডিরেক্টর জেনারাল।
বইটি সংগ্রহের জন্যে ক্লিক করুন https://www.ababhashbooks.com/rabindranath-shilparup-pathrup-grantharup.html