ABABHASH A Kolkata-based Publisher in the Business of Ideas

Recently added item(s) ×

You have no items in your shopping cart.

প্রাসঙ্গিক

পরের এতগুলো পাতায় এত্ত এত্ত কথা লিখে নিজের বক্তব্য যদি বুঝিয়ে উঠতে না পারি, তাহলে বইয়ের শুরুতে বাড়তি কিছু শব্দ লিখে দিলে সেই কথাগুলো বুঝিয়ে ফেলা যাবে --- এমন অলীক প্রত্যাশা আমার নেই। অতএব, ভূমিকা হিসেবে যে অংশটুকু জুড়ছি, তার মধ্যে বইয়ের মুখ্য উপপাদ্য বিষয় জুড়ে দেওয়া হচ্ছে না। ভূমিকা বলতে এই বইয়ের হয়ে ওঠার আবহ, এটুকুই।
     গত শতকের শেষে আমার ডাক্তারি জীবনের শুরু (এমবিবিএস পাস ১৯৯৮ সালে, তারপর যথাক্রমে ইন্টার্নশিপ এবং হাউসস্টাফশিপ) --- দিশাহীন স্বভাবের গুণে প্রকৃত অর্থে যাকে ডাক্তারি বলে, সেই চেষ্টা শুরু করতে করতে প্রায় আমার আরও এক দশক দেরি হয়ে যায়। কিন্তু সে-প্রসঙ্গ এক্ষেত্রে অবান্তর। তবে সাফাই হিসেবে যে-কথা বিশেষ করে বলার, এই সময়কালের মধ্যে আমি কখনোই লেখালিখি করিনি (কৈশোরের শেষে কিছু কবিতা লেখা বাদে --- যেটুকু না করলে নিজের বাঙালিসত্তাকে অপমান করা হয়, সেটুকুই --- এবং অগ্রজপ্রতিম অনিন্দ্য রায় এবং তমোজিৎ গোস্বামী উসকানি না নিলে সেগুলো দিনের আলো, থুড়ি কলেজ ম্যাগাজিন ও কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনের মুখ দেখতে পেত না)। নিজেকে নিবিষ্ট পাঠক হিসেবেই চিনতাম (এখনও তা-ই চিনি), হঠাৎ করে নিজেকে লেখক ভেবে বসার মতো বিভ্রান্তির কোনও কারণ তখনও ছিল না, আজও নেই। অথচ, নিজেকে লেখক না-ভাবার পরও, এদিক-ওদিক পত্রপত্রিকায় আমার বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে, দু-চারজন সেসব লেখা পড়েছেন, এমনকী একাধিক বইও প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে - বর্তমান বইয়ের প্রসঙ্গে তার কারণ বা পটভূমিকা বিষয়ে সামান্য কিছু কথা বলে রাখা যাক।
     ডাক্তারির চেষ্টা, মানে ক্যানসার-চিকিৎসক হওয়ার চেষ্টা করতে করতেই, ওই ২০১৬-র শেষ অথবা ২০১৭-র শুরু নাগাদ সরকারের ক্যানসার চিকিৎসা নীতির খামতি বা অসঙ্গতি বিষয়ে কিছু ভাবনা মাথায় আসে (সম্ভবত আরেকটু আগেই মাথায় এসেছিল --- তবে লেখাটা ওই সময়েই) --- অগ্রজপ্রতিম নীলাঞ্জন হাজরা সেসময় একটি সংবাদপত্রে কর্মরত ছিলেন, এটা-সেটা কথাপ্রসঙ্গে ভাবনাগুলোর কথা বলাতে তিনি গুছিয়ে লিখে ফেলতে বলেন, বিস্তর দোনামনা নিয়ে লেখা সেই নিবন্ধটিই আমার প্রথম লেখা। একটি খবরের কাগজে উত্তর-সম্পাদকীয়। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, একবার শুরু করে দিলে নিজেকে সামলানো দুরূহ হয়ে দাঁড়ায় (আর আত্মসংযম কখনোই আমার স্ট্রং পয়েন্ট নয়) --- তদুপরি দেশের স্বাস্থ্য-চিকিৎসার যা সামগ্রিক পরিবেশ-পরিস্থিতি, তার সুবাদে বিষয়েরও কমতি পড়ে না --- এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের উৎসাহ তথা পিঠ চাপড়ানিও জুটতে থাকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই --- অতএব, দেখতে দেখতে অনেক লেখা হয়ে গেল। খবরের কাগজে, পত্রপত্রিকায়, ওয়েবজিনে। সংখ্যাটা এতই বেশি, যে, ২০১৯ সাল নাগাদ চৈতালীদি, কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, বললেন, লেখাগুলো --- অন্তত নির্বাচিত কিছু লেখা --- সাজিয়ে একখানা বই করতে। এমনিতে লেখাপত্র গুছিয়ে রাখার ব্যাপারে আমার দক্ষতা লোক ডেকে নেমন্তন্ন করে দেখানোর মতো --- কিন্তু এক্ষেত্রে যেহেতু সব লেখা-ই ই-মেইল করে পাঠানো এবং অনেকগুলোই ফেসবুকের দেওয়ালে সাঁটানো, তাই অনেকগুলোই খুঁজে পাওয়া গেল। সেসব থেকে ঝেড়েঝুড়ে, কিয়দংশে পুনর্লিখনের শেষে, একটা পাণ্ডুলিপি দাঁড় করানো গেল। ২০২০ সালে ধানসিড়ি থেকে প্রকাশ পায় আমার সেই বই - কিনে আনা স্বাস্থ্য : বাজার-পুঁজি-মুনাফা আর আপনি
      কিনে আনা স্বাস্থ্য - আমাকে হতভম্ব করে সে বই বাজারে ভালোই চলল, এমনকী কেউ কেউ ভালোও বললেন (অন্তত কেউই বইটিকে সম্পূর্ণত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেন না) --- বছরদুয়েকের মধ্যেই বইটির প্রথম সংস্করণ যাকে বলে ‘নিঃশেষিত’ হয়ে গেল। এই প্রসঙ্গে ধানসিড়ি-র কর্ণধার --- শুভ বন্দ্যোপাধ্যায় --- তাঁকে ধন্যবাদ না জানানোটা অনুচিত হবে। বইটা ছাপার আদৌ অর্থ হয় কি না, সে নিয়ে আমার সৎ সংশয় অগ্রাহ্য করে তিনি অসম্ভব যত্ন নিয়ে বই ছেপেছিলেন --- এবং প্রকাশকের কাছ থেকে একজন অপরিচিত লেখক তার প্রথম বই নিয়ে যা যা আশা করতে পারে, তিনি তার চাইতে বেশিই করেছিলেন।
     প্রথম বইয়ের ক্ষেত্রে ‘আশাতিরিক্ত সাফল্য’ পেলেও বইটি নিয়ে আমার মনে বেশ কিছু খুঁতখুতানি ছিল। সন্তানের প্রতি অগাধ অপত্যস্নেহ থাকলেও তার দোষত্রুটি চোখে না পড়লে মুশকিল। বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করার সময় লেখাগুলো নতুন করে লিখেছিলাম বটে, কিন্তু বইয়ের লেখাগুলোর মধ্যে নিজস্ব কোনো যোগসূত্র সেভাবে ছিল না --- মোটের উপর বইটা একটিই বই না হয়ে অনেকাংশে একটি প্রবন্ধ-সংকলন হয়ে দাঁড়িয়েছিল (তা খুব দোষের, এমন বলতে চাইছি না), যার বেশ কিছু প্রবন্ধ, বিষয়গত কারণে, আরও বিস্তারিত হওয়া উচিত ছিল। এবং কিছু প্রবন্ধ প্রকাশের বছরকয়েকের মধ্যে, সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক না হলেও, পাঠকের আগ্রহের বৃত্তে না থাকাই সম্ভব। তো কিনে আনা স্বাস্থ্য-কে বই হিসেবে বাতিল করতে চাইছি না --- কিন্তু সেই বইয়ের নতুন সংস্করণ করা মুশকিল, কেননা বদলাতে হলে এত কিছু বদলাতে হয়, যাতে বইটাই বদলে যায়। সুতরাং নতুন সংস্করণের দিকে আর এগোনো হয়নি --- কিনে আনা স্বাস্থ্য বইয়ে হিসেবে, ভালোমন্দ যেমনই হোক, থাকতে চাইলে সেরকমই থাকুক।
     ইতোমধ্যে, মাঝের এই বছরগুলোয়, স্বাস্থ্য-জনস্বাস্থ্য-চিকিৎসারদর্শন নিয়ে আমার ভাবনাচিন্তা --- আগের চটজলদি অর্বাচীনতার তুলনায় --- খানিকটা গভীর হতে পেরেছে। তদুপরি চিকিৎসক সংগঠন তথা চিকিৎসক-আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকার সুবাদে অনেককিছুই দেখার সুযোগ ঘটেছে, যার সবটাই প্রীতিকর নয় (এবং যার অনেক কিছু নিয়েই প্রকাশ্যে কথা বলাও মুশকিলের)। মাঝে, ২০২২ সালে, বাবা মারা গেল --- আমার জীবনদর্শন জীবনবোধ সবকিছু তৈরি হয়েছে বাবাকে সামনে রেখে --- সামনে থেকে এত নিবিড়ভাবে এমন ঘনিষ্ঠজনের মৃত্যু আগে দেখিনি --- আমার স্বাস্থ্য-চিকিৎসা বিষয়ক ভাবনার বদলের ক্ষেত্রে বাবার মৃত্যুর অভিঘাত অনস্বীকার্য। তো, ২০২০ সালে আগের বইটি প্রকাশিত হয়েছিল এবং ২০২৪-এ বর্তমান বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের হাতে যাচ্ছে --- মাঝের এই চারটি বছর, আমার জীবনে ঘটনাবহুল। তাছাড়া মাঝে ঘটে গিয়েছে আস্ত একটি অতিমারি, সমাজজীবনে এবং প্রায় প্রত্যেকের ব্যক্তিজীবনে যার প্রভাব (চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে কথাটা তো আরও বেশি করে প্রযোজ্য) তো বলা-ই বাহুল্য। সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে, আধা-আনাড়ি হয়ে রাজা-উজির মারার জায়গা থেকে খানিকটা হলেও অভিজ্ঞ হতে পেরেছি, দু-চারটে কথা বলার ‘অওকাত’ অর্জন করতে পেরেছি (অন্তত তেমনটাই আমার বিশ্বাস)। লেখালিখিও, আমার চোখে, আগের তুলনায় পাঠযোগ্য হয়েছে। সেদিক থেকে ভাবনাচিন্তা করতে গিয়ে স্থির করলাম, আমার লেখা যখন সত্যিসত্যিই কিছু মানুষ পড়েন --- এমনকী পড়ে ভালোও বাসেন --- এবং ‘অবভাস'-এর প্রকাশকমশাই যখন বই প্রকাশের ব্যাপারে আগ্রহী --- তখন স্বাস্থ্য-চিকিৎসা বিষয়ে অন্য একটি বইয়ের কথা ভাবা যেতেই পারে। অতএব, এই সেই বই।
     এতক্ষণে নিশ্চয়ই এটুকু অনুমান করতে পেরেছেন, যে, স্বাস্থ্য-জনস্বাস্থ্য-চিকিৎসাদর্শন --- ইত্যাদি-বিষয়ক আমার ভাবনা নিয়ে এই বই। গত কয়েক বছরে আমার ভাবনাচিন্তা আগের তুলনায় পরিণতি পেয়েছে, সেকথা এখুনি বললাম --- কিন্তু তার অর্থ এমন নয়, যে পুরোনো ভাবনাগুলো সব বাতিল করে ফেলেছি। অতএব, পূর্বতন বইয়ের কিছু ছাপ এখানেও রইল --- চিকিৎসা ও দুর্নীতি শীর্ষক অধ্যায়টি, হোসেন আলি-কে নিয়ে অধ্যায়, বিজ্ঞান ও প্রশ্ন সংক্রান্ত অধ্যায়টি, এরকম কিছু কিছু জায়গায় কিনে আনা স্বাস্থ্য-র ছাপ রয়েছে। কিন্তু সিংহভাগ ক্ষেত্রেই থাকছে সম্পূর্ণ নতুন লেখা --- পুরোনো অংশ যেখানে রাখা হয়েছে, সেখানেও লেখাটি নতুন করে লেখা। অর্থাৎ এই বই কোনো ভাবেই নতুন বোতলে পুরোনো মদ চালানোর প্রয়াস নয়।
     অবশ্য আরেকদিক থেকে দেখলে, যে বোতলেই ভরা যাক না কেন, মদটি পুরোনোই। অর্থাৎ, সব নাগরিকের সামর্থ্যের মধ্যে স্বাস্থ্য-চিকিৎসা তো যেকোনো সভ্য দেশের অবশ্যকর্তব্য হওয়া উচিত, নিদেনপক্ষে রাষ্ট্রের কাছে অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচ্য হওয়া উচিত --- এই বিশ্বাস। অর্থাৎ, মানুষের অসুস্থতা, রোগীর চিকিৎসা --- স্বাস্থ্য, সব অর্থেই --- কোনো ব্যাবসার ক্ষেত্র হতে পারে না --- এমন ভাবনা। মানুষ মাত্রেই মরণশীল --- সুস্থ নীরোগ জীবন, অসুস্থতার মুহূর্তে হয়রানিহীন চিকিৎসা এবং শেষবেলায় শান্তিতে মরার সুযোগ --- এটুকুই কাম্য। অথচ প্রতি ধাপেই তার উলটোটা ঘটতে দেখি। সুস্থতা বলতে হাসপাতালে দৌড়ে হেলথ-চেকআপ --- অসুস্থ হলে দেউলিয়া হওয়ার আতঙ্ক --- আর মৃত্যু বলতেই কাচের ঘর, হাজারো যন্ত্র। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে --- আর দেশের সবচাইতে সম্ভাবনাময় শিল্প বলতে ‘হেলথ কেয়ার ইন্ডাস্ট্রি’। এসব নিয়ে যা-চলছে, যেমন-চলছের বিপরীত ভাবনাকে পুরোনো মদ ভাবতে চাইলে ভাবতেই পারেন। স্বাস্থ্য-ই বলুন বা চিকিৎসাব্যবস্থা --- সে নিয়ে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী এবং রোগীপরিজন --- অনেকসময়ই যাঁরা সহযোগী সহমর্মীর পরিবর্তে যুযুধান দুই বিরুদ্ধপক্ষের ভূমিকায় --- দুই পক্ষেরই, পরস্পর-বিরোধী ও বিভ্রান্তিকর ধ্যানধারণা রয়েছে। অনেক বছর ধরে, অনেকেই, সে নিয়ে বলে/লিখে আসছেন --- আমি তাঁদের পথের অনুসারী মাত্র। তো যেকথা বলছিলাম, সেদিক থেকে দেখলে ‘মদ’-টি পুরোনোই বটে। আর এত বছর ধরে এত বার করে একই কথা প্রায় একই সুরে বলে যাবার পরেও যদি কথাগুলো আপনার কানে না ঢোকে, তাহলে ‘পুরনো মদ’-টিই আরও একবার পরিবেশিত হলে অন্যায় হবে কি !
     ভালোবেসে যত্ন নিয়ে এই বই ছাপতে আগ্রহী হয়েছেন পার্থবাবু --- অবভাস-এর পার্থ চক্রবর্তী --- তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞ রইলাম। আর বলব না বলব না করেও যাঁর কথা না-বলে থাকতে পারছি না --- পরিমল ভট্টাচার্য। এই বইয়ের পরিকল্পনা তথা ভাবনা নিয়ে প্রতি পদেই তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি --- লেখার মাঝপথে তাঁকে পাণ্ডুলিপি পড়তে দিয়ে মতামত চেয়েছি, সম্পূর্ণ হওয়ার পরে আবার পড়িয়েছি (বারবার পড়তে বাধ্য করেছি বলা-ই ভালো) --- তিনি এতটুকু ধৈর্য হারাননি। বরং মতামত জানিয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। সবমিলিয়ে কৃতজ্ঞতার চাইতেও, এক্ষেত্রে, আমার বিস্ময়ই বেশি। অতএব, এই বইয়ের মুখবন্ধ লেখার পক্ষে তাঁর চাইতে উপযুক্ত ব্যক্তি কেউ হতে পারেন না --- এবং স্বাভাবিকভাবেই, এ বাবদে তাঁকে আলাদা করে ধন্যবাদ জানানো মুশকিল। তাছাড়া, এতদিনে, সম্পর্কটা আর কৃতজ্ঞতা ধন্যবাদ জানানোর পর্যায়েও নেই।
     যাক গে, বই শুরু হওয়ার আগেই অনেক কথা বলা হয়ে গেল। আর বাড়াচ্ছি না। বরং এই অপ্রয়োজনীয় গৌরচন্দ্রিকার শেষে এবং বইয়ের শুরুতে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানো যাক এই বই যাঁরা ছাড়া সম্ভব হতো না, সেই সবাইকে। অর্থাৎ আমার মা, আমার স্ত্রী নিবেদিতা এবং আমার বছর-চোদ্দ-র ছেলে রঙ্গিতকে। এবং বাকি যাঁদের নাম আগেই করেছি, তাঁদের তো বটেই। এবং বিশেষ করে আপনাকে, যিনি বইটা পড়বেন, বা পড়ছেন, অন্তত পড়ার কথা ভাবছেন।
     সুস্থ থাকুন। ভালো থাকুন। সবাই। 
                                                       বিষাণ বসু

বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Sorry, you must be logged in to post a comment.