
...‘আজীবন ঘুরে বেড়াবার নেশা। কতবার কত জায়গায় ঘুরেছেন তার হিসেব নেই। কখনো পায়ে-হেঁটে, কখনো ট্রেনে বা মোটরে। কত মানুষের সঙ্গে দেখা — আলাপ-পরিচয়, কথাবার্তা। তারা কেউ সুখী কেউ দুঃখী। যে জায়গায় ভালো লাগত সেখানে বার বার যাওয়াই বুঝি 'পথের কবি'র ভ্রমণ-পিপাসার বৈশিষ্ট্য। প্রিয় জায়গা কখনো পুরোনো হতো না তাঁর কাছে।
লেখক মানুষ। প্রতি বছর অগাস্ট-সেপ্টেম্বর দুটি মাস ভরে থাকে শারদীয় লেখালেখির ব্যস্ততায়। ১৯৪৩-এর ২ অগাস্টের দিনলিপিতে তার উল্লেখ আছে: ১৪ অগাস্ট রাতে শেষ হলো 'মুক্তি' নামের গল্পটি হাজরা যুগীর বউ-কে নিয়ে লেখা। ২১ অগাস্ট বারাকপুর থেকে কলকাতা হয়ে ঘাটশিলা যাচ্ছিলেন — ট্রেনের কামরায় ঠাসাঠাসি ভিড়, চ্যাঁচামেচি, ঝগড়াঝাঁটি, একটু দাঁড়াবার জায়গার জন্য ধাক্কাধাক্কি। সেই অকথ্য ভিড়ের মধ্যে এক বৃদ্ধ মুসলমান যাত্রী কাঁদছিলেন — তাঁর বাইশ বছরের জোয়ান ছেলে মরে গেছে। সেই খবর পেয়ে তিনি যাচ্ছেন। 'পথের কবি' শুনলেন সেই হতভাগ্য বৃদ্ধের কথা। তাঁর কল্পনার পাখনা সেই হৈহট্টগোলের মধ্যেও উড়াল দিল এক নতুন রাজ্যে — সেখানে-গাড়ির হৈহট্টগোল-চ্যাঁচামেচি-ঠ্যালাঠেলি কিছু নেই — সে এক অন্য রাজ্য। একে একে সবাই শুনলো বৃদ্ধের মর্মান্তিক দুঃখের কথা। যেন কোনো যাদুমন্ত্র — স্তব্ধ হয়ে গেল যাবতীয় কোলাহল — বৃদ্ধের একার দুঃখ ছড়িয়ে গেল সবার মধ্যে। 'পথের কবি'র কল্পনার যাদুতে 'ভিড়' নামে গল্পটি প্রকাশ পেল 'শনিবারের চিঠি' পত্রিকায়। গল্পে কোলাহল মুখর ট্রেনের কামরা লেখকের কলমের যাদুতে স্তব্ধবাক।
এরকম একটি নয়, আরও অনেক গল্পের রসদ সংগ্রহ করেছেন বিভূতিভূষণ। পথে যেতে যেতে যা পেয়েছেন 'খুদ কুঁড়ো' কাউকেই, কিছুকেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেননি, সঞ্চয় করে রেখেছেন মনের নিভৃতে। হয়তো কয়েকদিন কি কয়েক মাস, এমনকি বছরের পর বছর পেরিয়ে যাবার পরেও মনের মণিকোঠায় যত্নে সঞ্চয় করে রাখা সেই স্মৃতির কুঁড়িটি পাপড়ি মেলে হেসে উঠল একটি পূর্ণ প্রস্ফুটিত ফুল হয়ে। একেই আমরা বলছি 'বিন্দু থেকে সিন্ধুতে'। একটি নয়, দুটি নয়, বিভূতি সাহিত্যের অনেক গল্পই এমনি করে কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফুটে ওঠার কাহিনি। আমরা এখানে আটটি নমুনা হাজির করেছি।’ ...
— অজয় গুপ্ত
বইটি সংগ্রহ করতে ক্লিক করুন।