Review Details
NAHUMER GRAM O ONYANYO MUSEUM
- Product Review (submitted on October 15, 2021):
-
পাঠপ্রতিক্রিয়া, লিখেছেন সুদীপ চট্টোপাধ্যায়।
স্মৃতিপথ কি একরৈখিক? শুধুই আত্ম-সুখদুঃখের আনন্দ-বিলাপ, যা আমি ফেলে এসেছি বা নিজে রেখে এসেছি, তাদের বায়বীয় শরীরে হাত বোলানো? সাধারণত এমনই হয়ে থাকে অতীতচারণ। গড়ে ওঠে নিজেকে বেষ্টন করে। তার বলয় কখনো দূরগামী, কখনো-বা নিকটে। আবার ইতিহাসভিত্তিক রোমন্থন কখনো নিরাসক্ত ভঙ্গিতে নিরপেক্ষ চোখে, কখনো-বা তার আঁচ নিজের শরীরে নিয়ে। কিন্তু পরিমল ভট্টাচার্যের ‘নাহুমের গ্রাম ও অন্যান্য মিউজিয়াম’-কে কী বলা যাবে? স্মৃতিকথা? অতীতচারণ? নাকি একাধিক ঘটনা ও অনুভূতির ‘ক্ফারনাউম’(এই শব্দটির সঙ্গে আমার সদ্য পরিচয়, এই বইয়ের মধ্য দিয়ে)—যার সঙ্গে লেখকের সর্বদা সরাসরি যোগাযোগ নেই, অথচ সেই বাটারফ্লাই থিওরির মতো পরোক্ষ সংযোগ রয়েছে। এই বইয়ের সব থেকে শক্তিশালী দিক হল এর রচনাভঙ্গি, বর্ণনাশৈলী। পরিমল ভট্টাচার্যের পাঠক মাত্রেই জানেন তাঁর ভাষার মহিমা, জানেন একাধিক রেফারেন্স তিনি কী অসাধারণ মুনশিয়ানায় সম্পৃক্ত করে দেন বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনায়। এই যে আমরা হেঁটে বেড়াচ্ছি, কর্মস্থলে যাচ্ছি, বাড়ি ফিরছি, প্রেম নিবেদন করছি, ভালোবাসাঈর্ষাবিষাদে নিমজ্জিত হচ্ছি—আমাদের সঙ্গে কি প্রবহমান নয় বহুযুগ আগের হারিয়ে যাওয়া কোনও বন্দরনগরী, কোনও লুপ্ত সভ্যতা, কোনও মুছে-যাওয়া সংস্কৃতি, কোনও মৃত লেখকের গল্প তুলে আনার প্রয়াস, দীর্ঘ সময় নিজেকে ঘরবন্দি করে ফুসফুস ক্ষয় করে আমাদের সবার ক্রাইসিসকে দেখিয়ে দেওয়ার দানবিক প্রতিভা, কোনও গত-হওয়া চিত্রপরিচালকের কালজয়ী ছবি বানানোর অমানুষিক শ্রম ও মেধা, যে ছবির ভেতর আমাদেরই সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও নিটোল মন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, কিংবা সেইসব মৃৎপাত্র, মাটির ভেতর থেকে যারা পুনরায় উঠে এসছে বহুধাবিভক্ত হয়ে, অথবা সেই একপাটি লাল চটি, যা ফিরিয়ে দিয়েছে সমুদ্র, যার দোসরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কিংবা চীন দেশে তৈরি হওয়া সেই লাস্যময়ী নারী-পুতুল, ব্যবহৃত হতে হতে একসময় পরিত্যক্তা হয়ে ভেসে বেড়িয়েছে এক সমুদ্র থেকে আরেক সমুদ্র, আর তার নির্জীব অবসাদ পুরোমাত্রায় ছড়িয়ে দিয়েছে লোনা সমুদ্র থেকে পুরুষের লবণাক্ত শরীরে। স্মৃতি এমনই এক সহোদর যা অতীতকে পাকে পাকে জড়িয়ে বড় হতে থাকে আর বড় হতে হতে একদিন ছাড়িয়ে যায় আমাদের দৈহিক বয়স, প্রলম্বিত হতে হতে সে অনায়াসে ছুঁয়ে ফেলে প্রস্তর যুগের গুহাগাত্রে অঙ্কিত কুকুরের মুখ আর তার পাশে জেগে থাকা কিশোরীর হাতের মলিন ছাপ, তার উর্বর মাটিতে যে-কোনও সময় মাথা তুলতে পারে বাতিল চশমা-হাতঘড়ি-ক্রাচ-শিশুরপোশাক-ফ্রেমে বাঁধানো ছবি-মাইকের চোঙ, অথবা এক বিশেষ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর একান্ত অনুভূতি, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাহিত হয় উত্তরপ্রজন্মে, যা অন্য কোথাও আর কোনও মানবগোষ্ঠীর মধ্যে পাওয়া সম্ভব নয়। এই সমস্ত কিছু এবং আরও কিছু নিয়ে এক বিস্ময়কর মিউজিয়াম হল এই বই—বহুস্তরীয় ঘটনা, ভাবনা ও অনুভূতির ‘প্যালিমসেস্ট’। পড়তে পড়তে থেমে যাই, চোখ নিবদ্ধ হয় সামনের দেয়ালে। দেয়াল স্বচ্ছ হয়ে আসে, দেখি সেখানে পিঠ রেখে আমারই দিকে তাকিয়ে আছি আমি, আর দেয়ালের উলটো পিঠে ভর দিয়ে উলটো মুখে যে দাঁড়িয়ে, আমারই মতো তারও পিঠের পেশি তির তির করে কাঁপছে...
** ক্ফারনাউম-এর একটি পোশাকি মানে অবশ্যই আছে, কিন্তু তা পেরিয়ে সে যে অর্থান্তরে গেছে তার প্রকৃত অনুভূতি এই বই আদ্যোপান্ত না পড়লে বোঝা সম্ভব নয়
সৌজন্য - ফেসবুক